ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - ব্যাঙ্গমি বিতর্ক

ব্যাঙ্গমি বিতর্ক

সূর্যের সোনালী আলোয় ঝাঁ চকচকে দুপুর। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বসেছিল নির্জন পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে। শহরের ওয়াচ টাওয়ারের মতো চারপাশের সব কিছুই সেখান থেকে দৃশ্যমান। দুজনেই অনেকটা পথ উড়ে এসে বসার পর ব্যাঙ্গমি একটু বেশিই ক্লান্ত। ঘুম ঘুম ভাব। ঝিমাচ্ছে। ব্যাঙ্গমার অবশ্য ততটা হয়নি। সে ৩৬০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা ভাল করেই দেখে নিল। পরস্পরের সঙ্গী হিসেবে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি দুজন দুজনকে যথেষ্ট ভালবাসে। তবে ব্যাঙ্গমা চাইতো ব্যাঙ্গমি যেন তাকে একটু মেনে চলে, সমীহ করে। তো ব্যাঙ্গমা এবার আদেশের ভঙ্গিতে ব্যাঙ্গমিকে বলল, ‘শোন, তুমি এই পাহাড়ের চারপাশে দেখতে পারবে। শুধু দক্ষিণ দিকে তাকাবে না।’

ঝিমানো অবস্থায় থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে কান দুটো খাড়া হলো ব্যাঙ্গমির। সে আর কোন দিকে না থাকিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে তাকালো। ব্যাঙ্গমা রেগে ফায়ার-‘তুমি কেন আমার কথা শুনলে না? এত করে বললাম দক্ষিণ দিকে তাকাবে না। আর সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার কথা অমান্য করলে! আমি তোমার সঙ্গে আর সংসার করব না।’ এবার ক্ষিপ্ত হলো ব্যাঙ্গমি, ‘তুমি এমন কি ঘোড়ার ডিমটা দেখেছ যা দেখতে আমাকে নিষেধ করেছ?! কই আমি তো কিছুই দেখলাম না।’

তুমুল বাকযুদ্ধ শুরু। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনে কেউ ক্ষান্ত হচ্ছে না। কেউ কাউকে মেনে নিচ্ছে না। ব্যাঙ্গমা বলছে, ‘হুহ্! আমি তোমার সিনিয়র, আমি তোমার হাজব্যান্ড। আর তুমি আমার আদেশ শুনবে না! এটা কি হয়! আমি আগেও দেখেছি তুমি আমার কথা খুব একটা শুনতে চাও না।’
ব্যাঙ্গমির ফটাফট জবাব, ‘হাজব্যান্ড হয়েছ তো কী হয়েছে? আলাদা শিঙ গজিয়েছে? বেশি হাজব্যান্ড, হাজব্যান্ড মারাবা না। আর তুমি আমার কিসের সিনিয়র? মেয়েদের মেন্টাল মেচ্যুরিটি অনেক আগে আসে। সেই সেন্সে আমি তোমার সিনিয়র।’

ব্যাঙ্গমা ইনিয়েবিনিয়ে নানা পুরুষতান্ত্রিক আগডুম-বাগডুম বলার চেষ্টা করল। সব শুনে এইবার ব্যাঙ্গমি আরো ক্ষেপে গিয়ে বলছে, ‘শোন, সংসারের দায়িত্ব পালন বল, আয় রোজগার বল-কোন কিছুই তুমি আমার চেয়ে বেশি কর না। অতএব আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর তুমি কোন নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে পার না। কই, আমি তো তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না। আমি হয়তো দক্ষিণ দিকে তাকাতামই না। কিন্তু তোমার নিষেধাজ্ঞা আমাকে সেদিকে তাকাতে বাধ্য করেছে।’

ব্যাঙ্গমির কথার চাবুক চলছে, ‘তুমি সেদিন আমাকে আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছ। তখনই বুঝলাম তুমি আমাকে সন্দেহ কর। আমরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ তাতে সন্দেহ নাই। আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তবে একটা কথা মনে রাখবা, মনের কিন্তু বিয়ে হয় না। না তোমার, না আমার। আমি যার সঙ্গে ইচ্ছা তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তুমি তাতে না করতে পার না। বরং তোমার এই নিয়ন্ত্রন, তোমার এই নিষেধাজ্ঞা তোমার সন্দেহগ্রস্ত দুর্বল ব্যক্তিত্বটাই সামনে তুলে ধরে।’
ব্যাঙ্গমা চুপ। শুধু কান খোলা।

‘আসলে আমি বলতে চাইছি মনকে কোন সম্পর্কের ফ্রেমে বেঁধে ফেলা যায় না। শৃঙ্খলিত করা যায় না। সেটা উচিৎও না। প্রত্যেকটি সম্পর্কের ডাইমেনশন আলাদা। অবস্থান ভেদে মনের আচরণ ভিন্ন ভিন্ন হবে। তুমি একটার সঙ্গে আরেকটা কমপেয়ার করবা না। তবেই শান্তি পাবা।’

ব্যাঙ্গমি বলে যাচ্ছে, ‘আমরা তো পাখি, ইচ্ছা হলেই যেখানে সেখানে উড়ে যেতে পারি। মনের স্বাধীনতা চাইলেই উপভোগ করা সম্ভব। তোমাকে একটা গল্প বলি, শোন। এই যে নিচে পৃথিবীতে এত শত মানুষ দেখছো, তাদেরও কিন্তু একই অবস্থা। সঠিকভাবে বললে, একই না, বরং আরো জটিল অবস্থা। তাদেরও বিয়ে হয়, সংসার হয়। তবে তাদেরও মনের বিয়ে হয় না। কিন্তু মানুষ অত্যন্ত ভণ্ড প্রাণী বলে এরা সত্যটা স্বীকার করে না। সামাজিক শৃঙ্খল, ধর্মের দোহাই, নানা ভয়ভীতি এসবের কারণে এরা শৈশব বাদ দিলে বাকিটা জীবন অবদমনের ভিতর দিয়ে কাটিয়ে দেয়। বিশেষ করে প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা চার দেয়ালে ভীষণ রকম অবদমিত জীবন কাটায়। মনটাকে এরা বনসাইয়ের মতো সাজিয়ে রাখে। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে এরা সেই বনসাইয়ে গজিয়ে ওঠা শাখা-পাতা ছেঁটে পরিপাটি করে। যে কারণে এদের ইচ্ছারা আর প্রজাপতির পাখায় দোল খেতে চায় না। এরা আকাশ দেখতে ভয় পায়, বজ্রের ঝিলিক দেখলে কুঁকড়ে যায়। অবদমিত জীবন আর বিকলাঙ্গ জীবনে খুব একটা পার্থক্য নেই। সত্যি বলতে জীবন বাঁচানোর নামে এরা প্রায় প্রতিদিন জীবনকে হত্যা করে। তুমিই বল, তুমি কি স্বেচ্ছায় এই রকম বিকলাঙ্গ জীবন বেছে নেবে?’
‘প্রশ্নই আসে না, অবশ্যই না।’ সতর্ক জবাব দিল ব্যাঙ্গমা।
‘তুমি কি নিজের সঙ্গে ভন্ডামি করতে চাও?’ ব্যাঙ্গমির ফের প্রশ্ন।
‘না, তাও চাই না।’
‘তাহলে আমার মন তোমার ইচ্চার খাচায় বন্দি থাকুক, সেটাও নিশ্চয়ই চাও না?’
ব্যাঙ্গমা চুপ।
‘কথা বলছ না কেন? সমস্যা কোথায়?’
ব্যাঙ্গমা এখনও নিরুত্তর।

এবার ক্ষেপে গিয়ে ব্যাঙ্গমার কানের কাছে গিয়ে ব্যাঙ্গমি বলল, ‘এটাই তোমার পুরুষতন্ত্রের সমস্যা। তোমাকে আর আমার হাজব্যান্ড মানতে ইচ্ছা করছে না। তোমার মাঝে নরপুরুষের প্রেতাত্মা ভর করেছে। যতদিন তুমি সেই প্রেতাত্মামুক্ত হতে না পারবে, ততদিন তুমি আর আমার খোঁজ নেবে না।’
এই বলে ব্যাঙ্গমি সোজা সেই দক্ষিণের দিকেই অজানা গন্তব্যে উড়াল দিল। ব্যাঙ্গমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানেই বসে থাকল। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টির অনেক আড়ালে
হারিয়ে গেল ব্যাঙ্গমি।

[শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা, জুন ২৮, ২০১৯]

লেখক > সাংবাদিক ও কবি

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...