ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - আন্তর্জাতিক মহান মে দিবস দীর্ঘজীবী হোক

আন্তর্জাতিক মহান মে দিবস দীর্ঘজীবী হোক

”উত্তম কুমার মজুমদার >>

আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম ও তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দিনটি অর্জিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের উপর বলা যায় অনেকটা কৃতদাসের মতো আচরণ করা হতো। মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরিব, উচ্চ-নিচ ইত্যাদি ভেদাভেদ এখনকার তুলনায় তখন ছিল অত্যন্ত প্রকট। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে মানুষ হিসাবে গণ্যই করা হতো না। তাঁদেরকে বিভিন্ন কারখানায় বা কর্মস্থলে কোথাও দৈনিক ১০ ঘন্টা, কোথাও দৈনিক ১২ ঘন্টা, কোথাও দৈনিক ১৪ ঘন্টা, আবার কোথাও দিন-রাত ২৪ ঘন্টা শ্রমদানে বাধ্য করা হতো। বিনিময়ে তাঁরা যেমন বৈষম্যমূলক পারিশ্রমিক পেতেন, তেমনি সর্বদাই উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকেও বঞ্চিত হতেন। শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মেধা, শ্রম, ঘাম, রক্তঝরা উৎপাদিত পণ্য থেকে প্রাপ্ত আয়ের প্রায় পুরোটাই ভোগ-দখল করতেন শিল্প-কল- কারখানার মালিকপক্ষ। ফলে উপযুক্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত শ্রমিক- মেহনতি-গরীব মানুষ তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এক দুর্বিসহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হতেন। তাই শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর- ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের মতো গরীব মানুষদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল এবং তাঁদের দ্বারা পরিচালিত শ্রমিক সংগঠনগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে শ্রমিক-মেহনতি মানুষদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অধিকার নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছিল। এভাবে সৃষ্টি হয়েছিল শ্রমিক-মেহনতি মানুষের আন্তর্জাতিকতাবাদের। নিজ অধিকারের স্বপক্ষে আন্দোলনরত সংগঠনগুলো নিয়ে গঠিত সংস্থা ‘ফেডারেশন অব অরগানাইজড্ ট্রেডস্ এণ্ড লেবার ইউনিয়নস্’ ১৮৮৪ সালে শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত পাশ করে। যেমন-
(ক) ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের ন্যায্য সময় ৮ ঘন্টা।
(খ) দৈনিক কাজের ন্যায্য সময় ৮ ঘন্টা- এই দাবী পূরণের লক্ষ্যে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হল।
এই ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, তখন শ্রমিকদের কোথাও দৈনিক ১০ ঘন্টা, কোথাও দৈনিক ১২ ঘন্টা, কোথাও দৈনিক ১৪ ঘন্টা ধরে প্রতিদিন কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। ফলে ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে এই আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। ১৮৮৬ সালের এপ্রিলে এই আন্দোলনের সপক্ষে প্রায় ২,৫০,০০০ শ্রমিককে যুক্ত করা সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে এই আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল ‘আনারকিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। ফলে শিকাগো শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ রাজ্যটিতে আন্দোলনের ব্যাপকতা বৈপ্লবিক রূপ ধারণ করেছিল। শিকাগো শহরের পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্ষকলাপ হিসাবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়সহ তাঁদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই আন্দোলন দমন করার জন্য শিকাগোর ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ তথা শিল্পপতিরা যেমন বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছিল, তেমনি শিকাগোর ব্যবসায়ীদের দ্বারা গঠিত সংস্থা ‘শিকাগোস্ কমার্শিয়াল ক্লাব’ ২,০০০ ইউ. এস. ডলার খরচ করে ‘ইলিনয়ের ন্যাশনাল গার্ড’-এর জন্য একটি মেশিনগান কিনেছিল আন্দোলন দমন করার জন্য। এই আন্দোলন সংগ্রামের ফসল হিসাবে ১৮৮৬ সালের ১লা মে অনেক বস্ত্র তৈরির কারখানায়, জুতো তৈরির কারখানায়, মোড়ক বা বোচকা বাঁধাইয়ের কারখানায় আন্দোলনের মূল দাবী ‘দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ’ কতৃপক্ষ মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু, ১৮৮৬ সালের ৩রা মে শিকাগোর পুলিশ ‘ম্যাককর্মিক রিপার ওয়ার্কস্ ফ্যাক্টরি’-তে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর বিনাপ্ররোচনায় গুলিবর্ষণ করেছিল। ফলে ৪জন শ্রমিক নিহত ও বহু আহত হয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে ‘আনারকিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং পিপলস্ অ্যাসেসিয়েশন’ পরের দিন শিকাগোর ‘হেমার্কেট’-এ একটি প্রতিবাদ সভার ডাক দেয়। ওই সভার শেষে একটি প্ররোচনায় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে আবারও শ্রমিকেরা হতাহত হন। এভাবে একটি দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মালিকপক্ষ ও সরকার শ্রমিকদের মূল দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। যদিও শ্রমিকদের রক্তক্ষয় ঘটেছিল মূলত: ৩রা ও ৪ঠা মে ১৮৮৬ তারিখে; তবুও ১লা মে ১৮৮৬-কে কেন্দ্র করে সকল আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত, সংঘটিত ও পরিচালিত হওয়ার জন্য পবরবর্তীকালে জাতিসংঘ ১লা মে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা International Workers’ Day বা মে দিবস বা May Day’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল।
মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার হিসাবে শুধু ‘দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ’-এর দাবীকেই প্রতিষ্ঠিত করেনি, বরং মহান মে দিবসের প্রভাবে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের সামাজিক, মানসিক, চেতনা ইত্যাদি অবস্থারও বিকাশ সাধন হয়েছে। আমাদের দেশের মতো শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে রিক্সা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি, নৌকা, শিল্প-কারখানাতে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে একসময় ‘তুই-তোকারি, গালাগাল’ ব্যবহার করা হতো, এমনকি আরোহীর পছন্দমতো স্থানে যেতে না চাইলে তাঁদের উপর বল প্রয়োগও করা হতো। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সম্মানও। অবহেলিত মানুষের সম্মান বাড়লে বাড়ে দেশেরও সম্মান। শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অন্যান্য পেশাজীবীদেরও অধিকার অনেকাংশে বেড়েছে ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

“মহান মে দিবস দীর্ঘজীবী হোক্।
শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অধিকার রক্ষা পাক্।
সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হোক্।
সমাজ থেকে শ্রেণি-বৈষম্য দূরীভুত হোক্।”

Picture : Women garment-workers struggled for their rights on 1st May, 2014 in Bangladesh.

লেখক > গণিত শিক্ষক

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...