ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - চৈত্র দিনের নীলনাচ বিলুপ্তির দিকে

চৈত্র দিনের নীলনাচ বিলুপ্তির দিকে

দেবদাস মজুমদার >>

চৈত্র শেষে এসেছে নতুন বছর। বাংলার নতুন বছরের আগমনে গ্রাম বাংলায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা উৎসব আয়োজন। চৈত্র সংক্রান্তি আর বৈশাখী মেলা আবহমান বাংলার চিরায়ত উৎসব । চৈত্র সংক্রান্তির আর বৈশাখী উৎসবের আমেজ এখন গ্রাম বাংলয়। সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায় চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে নানা পূজার আয়োজন করে । বাংলা সালের পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে আদিকাল ধরে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব পালন করা হয়। এই চৈত্র সংক্রান্তির অন্যতম উৎসব হলো হিন্দু ধর্মালম্বিদের ঐতিহ্যবাহী নীল পূজা । আর এ নীল পূজায় চৈত্র মাস জুড়ে নীল নাচ ঐতিহ্যের উৎসব হিসেবে পরিচিত যা আজ বিলুপ্ত প্রায়। হিন্দু ধর্মীয় দেবতা রাঁধা-কৃষ্ণ সহ বিভিন্ন দেব দেবীর আকৃতিতে নিজেদের সাজিয়ে গ্রামের গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায় নীল নাচে মুখরিত হত। চৈত্র সংক্রান্তি আর বৈশাখী মেলায় । পুরো চৈত্র মাস জুড়ে উৎসবে মেতে উঠত গ্রাম বাংলার মানুষ। সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায় চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে এখনও নানা পূজার আয়োজন করে থাকে। আর চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রাম বাংলার হাটবাজারের ব্যবসায়িরা হালখাতা উৎসবের আয়োজন করেন। এসব আচার অনুষ্ঠন আজও হয় তবে ঐতিহ্যের নীল নাচ এখন আর তেমন দেখা মেলেনা।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোববার পহেলা বৈশাখে নীল পূজা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলার খেজুর বাড়িয়া গ্রামের নীল উৎসব, কাছিছিড়া গ্রামের বেপারী বাড়ির মাঠ, কবুতরখালী গ্রামে, গুদিঘাটা গ্রামে, কালিরহাট গ্রামসহ উপজেলার প্রত্যন্ত এলকায় নীল উৎসব ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ উৎসব গুলো শত বছরের পুরানো যা আজও টিকে আছে।

জানাগেছে, চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের অন্যতম পুজা হচ্ছে নীল পূজা বা শিবের গাজন। বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী আজ শনিবার শেষ চৈত্র আর আগামীকাল রোববার পহেলা বৈশাখ । আর বাংলা সালের বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী রোববার চৈত্র সংক্রান্তি সোমবার পহেলা বৈশাখ। দেশের হিন্দু ধর্মালম্বী সম্প্রদায় মঙ্গলবার পালন করবে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব। এদিনেই হবে ঐতিহ্যবাহী নীল পূজা। নীল উৎসবকে ঘিরে এখন গ্রামে গঞ্জের গৃহস্থের উঠান জুড়ে নীল নাচের আসর বসছে। হাটবাজারেও নীল নাচ উপভোগ করছে হাটুরে মানুষ। বাঙালীর চিরায়ত উৎসব ঘিরে গ্রামে গঞ্জে চলছে এখন বিশেষ উৎসবের উদ্দীপনা। নীল নাচের দল বর্ণিল দেবদেবীর সাজে নানা বাদ্যযত্রের অনুসঙ্গে নাচ গান করে মানুষের মনোরঞ্জনে এখন শেষ মূহুর্তে ব্যস্তসময় পার করছে। প্রতিটি নীল নাচের দলে ১০/১২জনের রাধা,কৃষ্ণ,শিব,পার্বতি,নারদসহ সাধু পাগল(ভাংরা)সেজে সকাল থেকে মধ্য রাত অবধি নীল নাচ গান পরিবেশন করেন। গ্রাম বাংলার সকল মানুষের কাছে দারুণ উপভোগ্য এই নীল নাচ। চৈত্র সংক্রান্তি মেলার দিনে নীল পূজা শেষে শেষ হবে এ নীল নাচ। নীল পূজার জন্য নীল নাচের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল,ডাল আর নগদ অর্থ সংগ্রহ করে। নীল পূজা মূলত চৈত্রের শেষ দিনের হিন্দু ধর্মীয় উৎসব হলেও আবহমান বাংলার উৎসবে তা সার্বজননীন এক উৎসবে পরিনত হয়।

উপকূলীয় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া,ভান্ডারিয়া,কাউখালী ও বরগুনার বেতাগী, পাথরঘাটা, আমতলী, তালতলী ও বামনায় নীল পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে। তবে আগে প্রতিটা ইউনিয়নে গড়ে ৩/৪ গ্রামে নীল উৎসব হত। এখন একটি উপজেলা গড়ে ২/৩টির বেশী নীল পূজার দেখা মেলেনা। ফলে নীল নাচের দলের সংখ্যাও আশংকা জনক হাওে কমে গেছে। প্রতিটিা নীল পূজার আয়োজকরা একটি করে নীল নাচের দল গঠন করত। এ নীল দল গ্রাম জনপদ,শহর ঘুরে নীল নাচ পরিবশেন করে নীল পূজার উৎসবে মানুষকে আমন্ত্রণ জানায়।

মঠবাড়িয়া উপজেলার খেজুরবাড়িয়া গ্রামের নীল উৎসব প্রায় ১৫০ বছরেরও পুরানো ঐতিহ্য।

মঠবাড়িয়া সদরের কাছিছিড়া গ্রামে গত অর্ধশত বছর ধরে নীল পূজা টিকে আছে। আজ শনিবার বিকালে সম্ভ্রান্ত বেপারী বাড়ির দিঘীর পাড় জুড়ে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া উপজেলার মাছুয়া, কবুতরখালী, মিরুখালী কুলু বাড়িতে নীল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে মিরুখালী কুলু বাড়ির নীল পূজা দেড় শত বছরেরও ুরানো ঐতিহ্য।

স্থানীয় মিরুখালী কুলু বাড়ির নীল উৎসবের অন্যতম উদ্যেক্তা শিক্ষক ভাস্কর চন্দ্র রায় জানান, নীল পূজা মূলত চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব । আগে এ জনপদের প্রতিটা প্রামেই চৈত্র দিনের নীল নাচে মুখরিত থাকত। কেননা প্রতিটা গ্রামেই এক নয় একাধিক নীল পূজা অনুষ্ঠিত হত। তখন নীল দলেরও সংখ্যা ছিল বেশী। এখন আর তা নেই। এখন সারা উপজেলায় ৩/৪টি নীল পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের নীল নাচ এখন প্রায় বিলুপ্ত।

ভা-ারিয়ার গৌরিপুর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী এ নীল পূজাও শত বছরের পুরানো। পুরো চৈত্র মাস ধরে ১২ সদস্যের নীল দল উপকূলীয় জনপদে নাচ গান করে ।এখানকার গৌরিপুর গ্রামের হাওলাদার বাড়ির পুকুর ও আশপাশের মাঠ জুড়ে এ নীল পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দিনব্যাপী এবারও নীল পূজা অনুষ্ঠান ঘিরে এখানে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশ বৈদিক আশ্রম মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ স্বামী সিদানন্দ স্বরস্বতী বলেন,নীল পূজা ও চৈত্র সংক্রান্তি মেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও তা বাঙালীর চিরায়ত উৎসব। এটি আসলে কালের আবর্তের উৎসব। নীল পূজা মানে শিব দেবতার গাজন (শিব পূজা)। হিন্দু ধর্মের পৌরনিক ধর্ম মতে,দেবতা শিব সমুদ্র মন্থনে বিষপান করে নীল কণ্ঠ ধারন করেছিল। আবার বৈদিক হিন্দু ধর্ম মবে,সূর্য অস্ত গেলে চারিধার গাঢ় অন্ধকার হয়ে আসে। গাঢ় অন্ধকার নীল বর্ণের হয়। এখানে বছরের আয়ূষ্কাল শেষ হওয়ার প্রতীকি হল এই নীল। কালের আবর্ত শেষ হয়ে আসে নতুন ভোর,নতুন কাল। পুরানো কালকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরে সংকট কেটে সুখ ও সমৃদ্ধির আশায় শিবের আরাধনা বা শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র শেষে শিবের গাজন উৎসবই হল নীল পূজা।

 

Leave a Reply

x

Check Also

পিরোজপুর জেলা বিএনপির আহবায়ক আলমগীর হোসেন আটক

পিরোজপুর প্রতিনিধি : বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও পিরোজপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেনকে আটক করেছে ...