ব্রেকিং নিউজ
Home - উপকূলের মুখ - গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মঠবাড়িয়ার নূর হোসেন এর জীবন দান

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মঠবাড়িয়ার নূর হোসেন এর জীবন দান

“স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক” এ স্লোগানটি সম্পর্কে আমরা সবাই পরিচিত। এ স্লোগানটি যিনি বুকে ও পিঠে ধারন করে লেঃ জেনারেল এইচ.এম. এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, তিনি হচ্ছেন নূর হোসেন। নূর হোসেনের পুরো পরিচয় আমরা অনেকেই জানি না। তার পৈত্রিক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলাধীন সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে (আমার বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার।) তার পিতার নাম মুজিবর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া এবং মাতার নাম মরিয়ম বেগম। মজিবর রহমান তার বাড়ির নিকটবর্তী নলী ভীমচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে তাঁর পিতা হাছেন আলী হাওলাদারকে কৃষি কাজে সহায়তা করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মেঝো ভাই চান মিয়ার সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকায় চলে যান। প্রথমে তিনি একটি হোটেলে কাজ করেন এবং মালিকের অনুমতি নিয়ে মাঝে মাঝে বেবী ট্যাক্সি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। অতপর তিনি হোটেলের কাজ ছেড়ে দিয়ে ভাড়ায় বেবী ট্যাক্সি চালাতে শুরু করেন। কয়েক মাস পরে তিনি মালিকের কাছ থেকে বেবী ট্যাক্সী ক্রয় করেন। তিনি ১৯৬১ সালে মুন্সিগঞ্জের মেয়ে মরিয়ম বেগমকে বিয়ে করেন এবং নারিন্দায় ভাড়া করা বাসায় বসবাস করতে থাকেন। এ বাসায় ১৯৬৫ সালে নূর হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে(চার ভাই ও এক বোন) তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই আলী হোসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ব্যাক্তিগত গাড়ীর ড্রাইভার ছিলেন। ২০১৬ সালে হজ্বব্রত পালন করার পূর্বে তিনি অবসর গ্রহন করেন। ১৯৭২ সালে তার পিতা নারিন্দার বাসা ছেড়ে দিয়ে বনগ্রাম রোডের মঠবাড়িয়ার উপজেলার হলতা নিবাসী এ্যাডভোকেট আবদুর রসিদ চৌধুরীর ৭৯/১নং বাড়ির একাংশ ভাড়া করেন। :

নূর হোসেন বনগ্রাম রাধা সুন্দরী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেনী পাশ করে বনগ্রাম গ্রাজুয়েট হাইস্কুলে ভর্তি হন।সেখানে ১০ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভিং ট্রেনিং গ্রহণ করতঃএকজন দক্ষ গাড়ি চালক হন।তিনি অাওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং বনগ্রাম শাখার প্রচার সম্পাদক হন।তিনি তাঁর পিতার সাথে মাঝে মাঝে পৈত্রিক নিবাস ঝাটিবুনিয়া গ্রামে অাসতেন।জেনারেল এইচ.এম.এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যে ১৯৮৩ সালে ৫ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অাওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল এবং বি.এন.পি এর নেতৃত্বে ৭ দল সমন্বয়ে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়।অান্দোলনের ফলে জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালের ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।নির্বাচনে অাওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট এবং জামায়াত – ই ইসলাম অংশগ্রহণ করেন।কিন্তু বি.এন.পি অংশগ্রহণ করেনি।নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হওয়ায় বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।এদিন নূর হোসেন তাঁর গায়ের জামা খুলে বুকে ও পিঠে সাদা রং দিয়ে “স্বৈরাচার নিপাত যাক,গণতন্র মুক্তি পাক” লিখিয়ে নিয়ে অাওয়ামী লীগের গণ মিছিলের সামনে গিয়ে ধ্বনি তুলেন ” স্বৈরাচার নিপাত যাক,গণতন্ত্র মুক্তি পাক”।মিছিলটি জি.পি.ও এর সামনে অাসলে পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে।ঘটনাস্থলে তিনি শহীদ হন।অতপর তাঁর বুকে ও পিঠের লেখা স্লোগানটি সারা দেশের জনতার স্লোগানে পরিণত হয়। ফলে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অমর এ শহীদের নাম অনুসারে জি.পি.ও এর জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নুর হোসেন স্কোয়ার।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৯১ সালে শহীদ নুর হোসেন এর নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছেন। নুর হোসেন এর বুকে ও পিঠে লেখা “স্বৈরাচার নিপাত যাক,গণতন্ত্র মুক্তি পাক” মানব পোষ্টার হিসেবে জাতীয় এবং অান্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।নুর হোসেনের পিতা ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।মাতা মরিয়ম বেগম এবং অন্যান্য ভাই বোন জীবিত অাছেন।গণতন্ত্রের এ অমর সৈনিকের পরিবারকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিরপুর-২ মাজার রোডে ৫ কাঠা জমি দান করেছেন এবং সেখানে শহীদ নুর হোসেন টাওয়ার নির্মিত হয়েছে।এ জন্যে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শহীদ নুর হোসেনের পৈত্রিক নিবাস ঝাটিবুনিয়ায়” শহীদ নুর হোসেন স্মৃতি পরিষদ” নামে একটি সংগঠন অাছে। এটি নুরুল অামীন রাসেলের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।এখানে পর্যাপ্ত অাসবাবপত্রের অভাব। নুর হোসেনর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অথচ তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সাপলেজা ইউনিয়ন পরিষদ,মঠবাড়িয়া পৌরসভা এবং মঠবাড়িয়া উপজেলা পরিষদ অাজ পর্যন্ত কিছুই করেননি।২০১৫ সালে অামি বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর গ্রামের ঝাটিবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নামকরণ “শহীদ নুর হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” এবং মঠবাড়িয়া পৌরসভার একটি রাস্তার নাম তাঁর নামে নামকরণের জন্যে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি অাকর্ষন করেছিলাম।পরিতাপের বিষয়,কর্তৃপক্ষ অামার অাবেদন অামলে নেননি। অামি অাবারও কর্তৃপক্ষের নিকটে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি বিষয়টি বিবেচনা করার জন্যে। অামার শেষ কথা হচ্ছে, এরশাদ বিরোধী অান্দোলনে নুর হোসেন, ডাঃ শামসুল অালম মিলন, বাবুল, অাবুল ফাত্তাহ সহ ৫০ জন নিহত ব্যক্তিদের (ভয়েস অব অামেরিকায় প্রচারিত সংবাদ তারিখ ২৯/১১/১৯৯০) জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে।পুনরুদ্ধারিত গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখার জন্যে সবাইকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। অাল্লাহ হাফিজ।

লেখক > অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সংগঠক মঠবাড়িয়া শেরে বাংলা সাধারণ পাঠাগার।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...