ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - স্মরণীয় ও অনুসরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন

স্মরণীয় ও অনুসরণীয় চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন

দেবদাস মজুমদার ➡️

কাগজের মানুষ, চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন । বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের স্মরণীয় এক নাম। তৃণমূল জনমানুষের সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সাধারণভাবে সংবাদ হয়ে ওঠেনা এমন সংবাদের তথ্যনুসন্ধানে তিনি ছিলেন অনন্য এক সংবাদ কারিগর। বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার ইতিহাসে তিনি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ এক সমৃদ্ধ সাংবাদিকতার পাঠ। নিভৃত গ্রামে গঞ্জে, পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে তথ্যানুসন্ধানী নানা মাত্রিকতার প্রতিবেদন করেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সংবাদ নেপথ্যের নানা ঘটনা। সৎ আর মানবিক দায়বোধের মোনাজাত উদ্দিন মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমেই অমর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অঙ্গনে।

আজ ২৯ ডিসেম্বর চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী । ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদী পারাপারের সময় তিনি ফেরী থেকে নদীতে পড়ে গেলে তাঁর অকাল মৃত্যু ঘটে। তৎকালীন সরকার এ মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। মোনাজাত উদ্দিনের সাংবাদিকতা অদ্যাবধি স্মরণীয় ও অনুসরণীয় গণমাধ্যমে। ১৯৯৭ সালে তিনি অর্জন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক পান।

মফস্বল সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা মোনাজাত উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৭ জুন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্ণেয়া গ্রামে। বগুড়ার সাপ্তাহিক বুলেটিন পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় আসেন মোনাজাত উদ্দিন। ১৯৬২ সালে দৈনিক আওয়াজ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদে উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

রংপুরের কৃতি সন্তান চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। শুধুমাত্র স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে তিনি এই পত্রিকাটি বের করার চিন্তা করেন। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাত উদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক। পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলেও লেখালেখির সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।

১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। টানা বিশ বছর ‘সংবাদ’ এ কর্মূখর ছিলেন। ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ।

রংপুরের মরনেয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষজীবন শুরু করে মোনাজাত উদ্দিন রংপুরের এক সময়ের নাম করা রংপুর কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং মানবিক শাখা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজেই। কিন্তু বিএ (পাস) পড়াকালীন হঠাৎ করেই পিতার মৃত্যুতে পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় মোনাজাতউদ্দিনকে। বাধ্য হন লেখাপড়া ছেড়ে দিতে। ছাত্র জীবনেই তাঁর লেখা লেখির সুচনা। সাংবাদিক হিসেবে প্রথম তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে । পরে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় কাজ করে ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন।

স্বাধীনতার পর রংপুর থেকে প্রকাশিত স্থানিয় দৈনিক রংপুর বন্ধ হয়ে গেলে চরম কষ্টে পড়েন। কারণ তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ । মোনাজাতউদ্দিনকে তাই জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নিতে হয় বাধ্য হয়ে।

এরপরে ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা। বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।

১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ধারণা করা হয়, পানিতে পড়ার সাথে সাথেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি ছিলেন জনগণের সাংবাদিক। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং পেশায় সফল এক নাম মোনাজাত উদ্দীন, দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে চিরবরনীয় হয়ে থাকবেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার।

রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন ।

চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন তাঁর কর্ম জীবনের সাধনা ও স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে রংপুর নাট্য সমিতি কর্তৃক সংবর্ধনা, ১৯৮৪ সালে পান সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক, আলোর সন্ধানে পত্রিকা তাঁকে ১৯৮৫ সালে সংবর্ধনা দেয়, ১৯৮৬ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়া কর্তৃক সম্মাননা সার্টিফিকেট অর্জন করেন, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য বাংলা ১৩৯৩ সালে পান ঐতিহ্যবাহী ফিলিপস্ পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে সংবাদপত্রে প্রভূত অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার পান, রংপুর পদাতিক গোষ্ঠী তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধনা দেয় ১৯৮৮ সালে, বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে, একই সালে লেখনীর মাধ্যমে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও জনপ্রিয় করার দুরূহ প্রচেষ্টা চালানোর জন্য সমাজ ও প্রযুক্তি বিষয়ক পত্রিকা ‘কারিগর’ সম্মাননা পান, ১৯৯৫ সালে মর্যাদাশালী অশোকা ফেলোশিপ লাভ করেন, রংপুরের নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯৬ সালে, ১৯৯৬ সালে তিনি লালমনিরহাট ফাউন্ডেশন ও উন্নয়ন সমিতি স্বর্ণপদক পান, ঢাকাস্থ রংপুর জেলা সমিতি তাঁকে গুণীজন হিসেবে সংবর্ধিত করে ১৯৯৫ সালে, ১৯৯৭ সালে পান রংপুর জেলা প্রশাসন কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা। খুলনায় তাঁকে রুমা স্মৃতি পদক প্রদান করা হয় ১৯৯৮ সালে। এছাড়া ওয়াশিংটনের পদ্মার ঢেউ বাংলা সম্প্রচার কেন্দ্র সম্মননা প্রদান করা হয় মোনাজাত উদ্দিনকে। তবে মোনাজাত উদ্দিন এই পুরস্কারের চাইতেও বড় পুরস্কার মনে করতেন মানুষের স্নেহ-শ্রদ্ধা ও ভালবাসাকে, যা তিনি অকুণ্ঠই পেয়েছেন।

মোনাজাত উদ্দিন তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। রিপোর্টিং ছাড়াও গল্প, কবিতা, ছড়া ও নাটক রচনায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর মৃত্যুর আগে ৯টি ও পরে ২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’।

তথ্যসূত্র:

বাংলা একাডেমী প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থ- ‘মোনাজাত উদ্দিন’ , লেখক- মোহাম্মদ জয়নুদ্দিন।

মোনাজাত উদ্দিন এর পথ থেকে পথে

 

Leave a Reply

x

Check Also

লাইটার জাহাজের ধাক্কায় চরখালী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে বিধ্বস্ত 🔴 যানবাহন চলাচল বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কঁচা নদীর চরখালী-টগরা ফেরিঘাটের চরখালী ঘাটে একটি জাহাজের ধাক্কায় ফেরির ...