ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - ইয়েস স্যার, উই আন্ডারস্টান্ড স্যার ……

ইয়েস স্যার, উই আন্ডারস্টান্ড স্যার ……

সাইফুল বাতেন টিটো >>
১৯৯৫/৯৬ সাল। খুব সকালবেলা প্রচন্ড হৈচৈ আর চিল্লাফাল্লায় অামার ঘুম ভেঙে গেলো। তখন আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি ফুলঝুড়িতে থাকি। আধোঘুম আধোজাগরনে আব্বুর রাগান্বিত কন্ঠও কানে এলো। আমি আমাদের সামনের ঘরে এসে দেখি আমাদের উঠানে অনেক মানুষ অর্ধচন্দাকৃতির হলে আছে একজনকে ঘিরে। যাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে তার চেহারা দেখলে বোঝার উপায় নেই সে কে… কারণ অনেক সময় বলে না মানুষ যে ‘মাইরা তোর চেহারা পাল্টাইয়া ফালামু’ এই লোকের চেহারা সত্যি সত্যি পাল্টে গেছে মাইর খেয়ে। আব্বু সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে বলছে
– এই কবির, শোনো ওকে আর মেরো না, এবার থানায় দিয়ে দাও।
– মাস্টারসাব থানায় দিয়া লাভ কি? আইজ আমরা ওর চৌখ তুইল্লা দিমু।
একথা বলার সাথে সাথে সমার্থকদের অভাব জুটল না। আব্বু দৃঢ় কন্ঠে বললেন
– তাহলে আর আমার কাছে এনেছ কেন? তোমরাই তো যা করার করতে পারো….
এবার সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো। যাকে মেরে ধরে ফাইনাল বিচারের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে সে আমাদের এলাকার বিশিষ্ট চোর। তার বাবাও বিশিষ্ট চোর। নাম মহারাজ। সে এক ভয়ঙ্কর চোর! যদি বলি দুর্ধষ চোর তাও কমিয়ে বলা হবে। ওরা বংশগত চোর বলেই আমরা চিনি। সদ্য কৈশর পার হওয়া চোরের রাজা মহারাজ আব্বুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিজের চোখ বাঁচানোর আশায়।
মুরুব্বি গোছের আলি চাচা বললেন
– দ্যাখেন মাসসাইব (মাস্টার সাব) আর কতো? ওর যন্ত্রণায় তো গ্রামবাসির অতিষ্ট। আপনি নিজেই ওরে আর ওর বাপেরে কয়বার বাঁচাইলেন। কত তওবা পড়াইলেন, কত খত নিলেন, কোন লাভ ঐছে? চুরি করা বন্ধ করছে? বাপ পোলা দুইজনেই তো চালাইয়া যাইতেছে সমানে… আইজ এর হালের গরু, কাইল ওর মুরগী, পরশু কারো ঘরে সিং দিলো (সিঁধ কেটে চুরি করা)। কি লাভ ওগোরে বাঁচাইয়া রাইখা? আই শ্যাষ কইরা দি। সবাই ওর চৌখ তুইল্লা দেই। দরকার পরলে গ্রামের সবাই মিলা ওরে চান্দা ধইরা খাওয়ামু।
কথা মোটেও মিথ্যা নয়। ওদের পরিবার ঐতিহ্য গতভাবে চোর। সেটা এগ্রামের মানুষ যেমন জানে তেমনি আশপাসের দুইচার গ্রামের মানুষও জানে। আব্বু গন্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক তাই তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয়েছে চোখ তোলার আগে।
শেষ পর্যন্ত আব্বুর জোড়ালো হস্তক্ষেপে বেঁচে গিয়েছিলো মহারাজের চোখ। মহারাজকে থানায় দেয়া হয়েছিলো। কয়েকদিন পরেই সে বের হয়ে আবার স্ব দায়িত্ব সুচারু রুপে পালন করতে লাগলো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মহারাজের চরিত্রের আরো কয়েকটি দিক বেরিয়ে আসতে থাকে। রেপের অভিযোগ ওঠে তার নামে। সত্যমিথ্যা জানি না। সর্বশেষে মহাররাজ ফেঁসে যায় খুন কেসে। এরপর আমরা গ্রাম থেকে ইউনিয়ন সদরে চলে যাই আব্বুর চাকরির কারণে। মহারাজ সম্পর্কে আর তেমন কোন খবর জানতাম না বা কখনও জানার দরকার হয়নি।
এর বছর দশেক পরের কথা। ইঞ্জিনিয়ার সেন্টার এন্ড স্কুল অব মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সদ্য পাশ করার পরপরই আমার পোষ্টিং হলো ১৯ ইসিবি (ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন) তে। বাঘাই হাট-মাসালং-সাজেক রোড বানাচ্ছি।
মাথার উপর প্রচন্ড রোদ সেই সাথে এঁটে আছে ফাইবারের বুলেট নিরোধক হেলমেট, পিছনে ৭.৬২ মিলিমিটার ক্যালিভারের সেমি অটোমেটিক রাইফেল, কোমরে ১২০ রাউন্ড তাজা অ্যামোনেশন। পাশেই টিনের পিপা কেটে বানানো ডোঙ্গায় ফুটছে বিটুবিন। আমার কাজ হচ্ছে পুরো কাজের মান, বিটুবিনের ঘনত্ব, বালির পরিমান, থিকনেস, ইটের কোয়ালিটি ইত্যাদি জিরো টলারেন্সে থেকে যাচাই করা। এ বিষয়ে অামাদের দীর্ঘ প্রশিক্ষন দিয়েছে, পড়াশুনা করিয়েছে সরকার। সো কোন ভুল হলে সরাসরি কোর্ট মার্শালে উঠাবে বিচারের জন্য। নো হাঙ্কি পাঙ্কি।
তো একদিন দুপুর বেলা কাজ চলছে….
হঠাৎ করে আমার কাছে এক লোক এসে বলল
– এ গেদু টিটো তুই বালো আছো?
এ ভাষা একেবারেই বরিশালের। আমি চমকে প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমি তাকে চিনি বাট মনে করতে পারছি না। কিন্তু বুঝতে পারছি সে এই রাস্তার কাজের লেবার ও আমার খুবই পরিচিত। আমি মুখে হাসি রেখে জিজ্ঞেস করলাম
– কে আপনি? আমি চিনতে পারিনি সরি….
– চিনবি ক্যাম্মে গেদু, তোরে তো দেখছি ছোড থাকতে। মুই কাশেম মিস্ত্রির পোলা মহারাজ।
সহসা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো
– চোর মহারাজ?
কিন্তু আমার আসপাশে সতির্থ আর সহকর্মী থাকায় খুব কষ্ট করে আটকিয়ে প্রশ্ন করলাম
– এখানে কি করেন আপনি?
– মুই তো গেদু এহন লংগদু থাহি। স্যাটেলার। ঐহানের এক কন্টেকদার তোগো এই কাম পাইছে, হেও স্যাটেলার। হের লগে কাম করতে আছি।
– ও, তা ভালো অাছেন?
– হ ভালো আছি গেদু, তোর আব্বায় মায় হ্যারা ক্যামোন আছে…..
আমি ঐ সময়ে স্যাটেলার বলতে আসলে কাদেরকে বোঝায় জানতাম না। পরে ধীরে ধীরে বুঝলাম।
– আপনে কি এহনও আগের কাম করেন?
এ কথার কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো চোরের রাজা মহারাজ। পরে আমি ধীরে ধীরে অাগ্রহ না করেও জানতে পারলাম স্যাটেলারের গল্প। শুনলাম এমন কোন স্যাটেলার নাকি নাই যার নামে লেভেল ল্যান্ডে অন্তত আট দশটা ভয়ঙ্কর কেস নাই। যার মধ্য অধিকাংশই নাকি রেপ, মার্ডার, ডাকাতি এইসব। সেকথা মহারাজই বলেছে আমাকে। এই সব ভয়ঙ্কর অপরাধীদের নাকি এখানে নিহত সেনা কর্তা মেজর জিয়া ঢুকাইছে। আমি শুনে অবাক! কিছুদিন পর ক্যাম্পে আমাদের স্যাটেলারদের সম্পর্কে ব্রীফ করা হলো। সব শেষে মেজর সাঈফ স্যার একটা কথা বলেছিলেন
‘এখানকার যে কোন স্যাটেলার শান্তি বাহিনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের থেকেও খারাপ। আমাদের দৃষ্টিতে শান্তিবাহিনীর লক্ষ্য উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ, কিন্তু ওরাও একটা আদর্শ নিয়ে লড়ে। আর স্যাটেলারদের কোন আদর্শ নাই, ওরা শুধু খারাপ মতলব নিয়েই ঘোরে। ওদের বুক-পিঠ বলে কিছু নাই। সো তোমাদের তিনটা জিনিষ থেকে সাবধান থাকতে হবে- এক মশা, দুই শান্তিবাহিনী এবং তিন নম্বরটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর সেটা হলো বঙালি স্যাটেলার। আন্ডজস্টান্ড?’
আমরা চিৎকার করে বললাম
– ইয়েস স্যার, উই আন্ডারস্টান্ড স্যার।

লেখক >> সাইফুল বাতেন টিটো, মিডিয়া কর্মী ।
১৭ জুন, ২০১৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...