ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - দূর-আকাশের তারা

দূর-আকাশের তারা

আখতারুজ্জামান আজাদ >>

সিনেমার নায়ক-নায়িকারা আমাদের মতো খান কি না, ঘুমান কি না, স্নান করেন কি না, তাদেরও আমাদের মতো ঘামাচি হয় কি না, তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেন কি না, প্রকৃতি আদৌ তাদেরকে ডাকে কি না— এই চিন্তায় শৈশবে অন্য অনেকের মতো আমারও ঘুম হতো না। পাশবিক পিতৃপ্রহার, মুহুর্মুহু মাতৃতিরস্কারকে উপেক্ষা করে ঝড়-বাদল-শৈত্যপ্রবাহ পায়ে দলে শুক্রবার বিকেল তিনটে কুড়ি মিনিটে বিটিভিতে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখতে যেকোনো উপায়ে অদূরবর্তী প্রতিবেশীদের বাড়িতে হাজির হতামই। সপ্তাহান্তে বিটিভিতে গোগ্রাসে সিনেমা গিলতাম আর নায়ক-নায়িকাদেরকে নিয়ে ভুগতাম রাজ্যের রূপকথায়। এক ছবিতে বিবাহিত নায়িকা অন্য ছবিতে অবিবাহিত হয়ে যান কী করে, এক ছবিতে নিহত ভিলেন অন্য ছবিতে জীবিত হয়ে যান কী করে, কী করে আজকের শুক্রবারের ধনাঢ্য নায়িকা পরের শুক্রবার দরিদ্র কাঠুরিয়ার কন্যা হয়ে যান— শৈশবে সে চিন্তায়ও ঘুম আসত না। কৈশোরে ঘুম আসত না উদ্বাহু ঊর্বশী নায়িকাদেরকে নিয়ে চিন্তা-অচিন্তা-কুচিন্তায়, ঘুম ভেঙে যেত স্বপ্নে নায়িকাদের অকথ্য অত্যাচারে।

নায়ক-নায়িকারা আমাদের কাছে দূর-আকাশের তারা অপেক্ষা দুর্লভ ছিলেন। তারাও রাতভর দেখা যায়, নায়ক-নায়িকা আড়াই ঘণ্টায় উধাও। বরগুনায় জন্ম-নেয়া জনৈক টিভি-অভিনেতার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য এখন থেকে দেড় দশক আগে কী করেছি, সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। আমার ঈশ্বর জানেন এক যুগ আগে সদ্য ঢাকায় এসে নায়ক-নায়িকা দেখার জন্য কতটা হাহাকার নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এফডিসির সদর দরোজায়, কনসার্ট শেষ হওয়া মাত্র গায়কের একটি স্বাক্ষরের আশায় জনতার কতটা ধাক্কা সয়েছি এই কৃশকায় আমি। আমার ঈশ্বর জানেন তৃতীয় গ্রেডের এক গায়িকার পাশে ছবি তুলতে পেরে আমি কতটা ধন্য বোধ করেছিলাম এক যুগ আগে, কতটা অধীর ছিলাম কলেজ-বন্ধুর বাড়ি গাজিপুরের শুটিং-কবলিত এলাকায় জেনে তার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে। কালের পরিক্রমায় রুপালি পর্দার তারকাদের প্রতি আগ্রহটা অবশ্য ক্রমশ ফিকে হয়েছে, অর্ধযুগের ফেসবুক-অভিজ্ঞতায় সেই আগ্রহ নেমে এসেছে হিমাঙ্কেরও নিচে।

যে নায়িকার অকথ্য অত্যাচারে ভোররাতে ঘুম ভেঙে যেত, সকালে শুভ্র শয্যায় আবিষ্কৃত হতো মালদ্বীপের মানচিত্র; যার কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠত আমার আসমুদ্রহিমাচল, যার চলনে-বলনে-ঢলনে দলিত-মথিত হতো আমার আপাদমস্তক; দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়— দু-বছর আগে তাকে ফেসবুকে আবিষ্কার করে দেখি তিনি একজন মুরাদ টাকলা। ইংরেজি অক্ষরে দুর্বোধ্য বানানে তিনি এমন দু-এক বাক্য বাংলা লেখেন; যা দাঁড়িয়ে পড়া যায় না, বসে পড়া যায় না, শুয়েও পড়া যায় না। যার মুখে রুপালি পর্দায় শুনে এসেছি এত-এত সোনালি সংলাপ, মুরাদ টাকলা ভাষায় তার পদ্যনির্যাতন দেখে ইচ্ছে করে ডেমরার ডাস্টবিনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে।

রুপালি পর্দায় যে নায়কের মুখে ভিলেনবিরোধী জ্বালাময়ী জেহাদি সংলাপ শুনে শৈশবে জ্বলে উঠেছি, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলেছি যে নিরস্ত্র নায়ককে সশস্ত্র পঞ্চাশজনকে খতম করতে দেখে, প্রিয় নায়িকাকে সজোরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে দেখে ঈর্ষায় অঝোরে অঙ্গার হয়েছি যে নায়ককে দেখে; সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে দর্শকদের উদ্দেশে সেই নায়কেরই বাণী শুনে নিজেকে কেবল একটি কথাই বলেছি— ধরণী, দ্বিধা হও, প্রবেশ করি! উদ্ভট উচ্চারণ, কর্কশ কণ্ঠস্বর, বেঢপ বপু আর অসংলগ্ন অর্বাচীনতা দেখে মনে হয়েছে— যে নায়ককে ঘিরে আমি শৈশবে মাতোয়ারা হয়েছি; এই লোক সেই লোক নন, এই লোক তার লুক অ্যালাইক কিংবা রেপ্লিকা। কোনো-কোনো চিত্রতারকাকে ফেসবুক লাইভে দেখে মনে হয় জাকারবার্গের বত্রিশ বছরের জীবনের বৃহত্তম ভুলটি হচ্ছে ফেসবুকে লাইভ অপশনটি চালু করা।

যখনই শৈশবের প্রিয় কোনো চিত্রতারকার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের দেখা পাই, টাইমলাইনে ঢোকার আগে আতঙ্কে দোয়া-দরুদ পড়ি; আশঙ্কায় থাকি— এই বুঝি উড়ে গেল প্রিয় তারকাকে ঘিরে আশৈশব লালিত আমার ফ্যান্টাসির ফানুশ। আমাদের শৈশবের অধিকাংশ তারকাই রেডিও মুন্না, বাঁশের কেল্লা প্রভৃতির গ্রাহক। তাদের টইটুম্বুর টাইমলাইন-জুড়ে শোভা পায় দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়ার উপায়ের লিংক; কোন দশ ধরনের নারীকে বিয়ে করতে নেই, কোন পনেরো ধরনের পুরুষকে ভালোবাসতে নেই— সেসবের লিংক। পাঁচ পা-ওয়ালা গরুর ছবি, ছয় মাথাওয়ালা গোখরার ছবি, প্রার্থনারত গাছের ছবি, ঈশ্বরের নামখচিত মাছের ছবি প্রভৃতিও ছেয়ে থাকে চিত্রতারকাদের টাইমলাইনে। থাকে সাতশো বছর আগে তোলা উপাসনালয়ের ছবিও; আমাদের তারকাদের মগজে এটুকুও খেলে না যে, সাতশো বছর আগে ছবি তোলার মতো যন্ত্র পৃথিবীতে ছিল না।

বাজারের টাকা, ইশকুলের পরীক্ষার ফি মেরে; কাগজ এক দিস্তার পরিবর্তে পৌনে এক দিস্তা কিনে দু-চার টাকা জমিয়ে শৈশবে নায়ক-নায়িকাদের ভিউ কার্ড কিনতাম আমরা। তাদেরকে পর্দায় দেখে সাধ মিটত না বলে, হাত দিয়ে যখন ইচ্ছে একটু ছুঁয়ে দেখব বলে ঐ বয়সে এই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছি। যে তারকাদের ভিউ কার্ড কিনে গভীর রাতে তা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখতাম, তাদের সেলফি-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এখন ইচ্ছে করে ‘সপ্তাহে দুটি সেলফির বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ মর্মে রুল জারি করার জন্য হাই কোর্ট বিভাগে রিট আবেদন দাখিল করতে। অতিভোজনে অমৃত যেমন বিস্বাদ লাগে, তারকারা বোঝেন না অতিদর্শনে দর্শকদের কাছেও তারকাদেরকে তেমনি বিস্বাদ লাগে। কিছু তারকা সেলফির ন্যূনতম নিয়মটুকুও বজায় রাখেন না। সেলফিতে তাদের সোনামুখের অর্ধেক দেখা যায়, তো বাকি অর্ধেক কাটা পড়ে; স্ফীত ভুঁড়ির অর্ধেকটা লুকিয়ে থাকে, তো বাকিটা উঁকি মারে। কারো-কারো সেলফিতে দন্ত মোবারক এমনভাবে বিকশিত থাকে যে, সেই দন্ত দেখে হন্তদন্ত হয়ে ফেসবুক থেকে পালাতে হয় এবং ইচ্ছে করে শৈশবে তার ভিউ কার্ড কিনে যে টাকা খরচ করেছিলাম, তা তার কাছে ফেরত চাইতে।

কোনো-কোনো তারকার দু-পঙক্তি পোস্ট পড়ে মনে হয় পঙক্তি দুটো রচনাকালে নিশ্চয়ই তার ন্যূনতম ছয়টি আঙুল ভেঙে গেছে এবং আঙুলগুলোয় বারোটি ব্যান্ডেজ করতে হয়েছে। অর্ধ-বাংলা সিকি-ইংরেজি সিকি-আরবি মিশ্রিত ঐ বাক্যদ্বয়ের ভেতর অর্ধডজন বানানভুল আবিষ্কার করতে-করতে ভাবি— এই ব্যক্তিটিই এক সিনেমায় বুয়েট থেকে বিবিএতে প্রথম হয়েছিলেন, এক সিনেমায় কুসুমপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছিলেন, আরেক সিনেমায় সখিপুর কলেজ থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ‘আজ থেকে বিশ বছর আগে’ সংঘটিত পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।

আমাদের তারকাদের প্রায় প্রত্যেকেই কবি। বিভিন্ন উৎসবে-পার্বণে চার-পাঁচ পঙক্তির পদ্য রচনা তাদের করতেই হবে। বাংরেজিতে রচিত ভুলেভালে ভরা সেসব পঙক্তিমালা পড়লে ‘এই পদ্য লইয়া আমি কী করিব’ বলে চিৎকার করতে-করতে ইচ্ছে করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কোনো গুহায় ঢুকে যেতে, যেখানে একসাথে সাপ ও কবিতার বাপ খেলা করে। জোড়াসাঁকোতে রবিঠাকুরের সমাধিতে গিয়ে এই পদ্য পাঠ করে শোনালে রবি বাবুও জীবিত হয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে নোবেল পদকটা ঐ তারকার হাতে তুলে দিয়ে আরেক দফা শ্মশানে ঝাঁপ দিতেন। পিটিয়ে গুন্ডাদেরকে উচিতশিক্ষা দেওয়া নায়কটি কিংবা ‘আমার সাগরকে এনে না দিলে আমি তোমাদের এক ফোঁটা পানিও খাব না’ বলে চিৎকার করে জাজিমে ঝাঁপ দেওয়া নায়িকাটি কিংবা ‘আজ তোকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে’ বলে শীৎকার করা ভিলেনটির মধ্যেও এমন পদ্যপ্রতিভা লুকিয়ে আছে, ফেসবুক নামক যন্ত্রটি এই ধরাধামে না এলে তা বোঝাই যেত না।

চিত্রতারকাদের ফেসবুক টাইমলাইন বিচিত্র বিনোদনের অপার উৎস। দূর আকাশ থেকেও দূরের যে অবস্থানে ভক্তরা তাদেরকে বসিয়ে রেখেছিলেন; তারা নিজেদেরকেই নিজেরা সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছেন মাটিতে, মাটি থেকে পাতালে, পাতাল থেকে অতল গহ্বরে। অবশ্য এই মোহভঙ্গেরও বড্ড প্রয়োজন ছিল; ভক্তদেরও জানা দরকার ছিল তারকারাও আমাদেরই মতো মানুষ, তারাও খাদ্য খেয়ে বাঁচেন, আমাদেরই মতো তারাও হাসেন-কাশেন কাঁদেন-ঝিমান।

রুপালি পর্দার তারকারা বেপর্দা হলে বেমানান লাগে, একই বদন দৈনিক দশবার দেখালে বদনখানিকে মদনখানি লাগে— চিত্রতারকারা যত দ্রুত এই সত্যটি উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল।

লেখক > কবি ।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...