ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - আমরা কখনও ভুলে না যাই আমরা সবাই মানুষ

আমরা কখনও ভুলে না যাই আমরা সবাই মানুষ

আগে আমি মাঝেমধ্যে শুক্রবার পানশালায় যেতাম। সেই শুক্রবার কল্যানপুর থেকে সাত নম্বর বাসে উঠলাম ঢাকা কলেজের সামনের এক পানশালার উদ্দেশ্যে। আমার সাথে উঠলো সাত-আটজন ছেলে। বাসে উঠে তারা যে যার মতো বসতে পারল বসল, কেউ দাঁড়িয়ে রইলো। নানা বিষয় নিয়ে খলবল করে কথা বলছে সদ্য টিনএজ পার করা ছেলে গুলো। একসময় কন্ডাকটর এলো ভাড়া চাইতে। তারা সাতজন মিলে ভাড়া দিলো বিশ টাকা। নামবে ঢাকা কলেজের সামনে। কন্ডাকটর ২০ টাকায় তাদের কোন ভাবেই নেবে না। কিন্তু ছেলে গুলোও আর একটাকাও বেশী দেবে না। কন্ডাকটরের কথা হলো কল্যানপুর থেকে ঢাকা কলেজ পর্যন্ত একেকজনের ভাড়া ১০ টাকা করে, তারা ছাত্র বলে পাঁচ টাকা করে দিক, তাতেও পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া আসে। বিশটাকায় সে কি করে নেবে? আমিও বাসের অন্যসবার মতো চুপচাপ আছি। বিষয়টি একসময় তর্ক থেকে ঝগড়া আর ঝগড়া থেকে হাতাহাতি আর হাতাহাতি থেকে চুড়ান্ত মারামারি লেগে গেলো। শুক্রবার হওয়ায় বাস ততক্ষনে ঢাকা কলেজের সামনে চলে এসেছে। বাসে আলাদা কোন হেল্পার না থাকায় কন্ডাকটর কাম হেলপারটি একা একদম কোনঠাসা হয়ে গেলো। হঠাৎ সবাই মিলে কলেজের সামনে নামিয়ে ফেললো কন্ডাকটরটিকে। শুরু হলো বেদম প্রহর। হিদশেহারা কন্ডাকটরের নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পরতে লাগলো। মূহুর্তেই মারার দল ভারি হতে লাগলো। পাশেই টহল পুলিশ থাকায় উদ্ধার পেলো কন্ডাকটর তথা বাসটি। আমার ধারণা পুলিশ আরেকটু পরে এলে ঢাকা কলেজের দোহাই দিয়ে বাসটি পুড়িয়ে দিতো সবাই মিলে। আমি জঞ্জাল এড়িয়ে পান শালায় ঢুকলাম। বিষয়টি সহসা মাথা থেকে দূর হলো না। আমি গ্লাসে ডুবে যেতে চেষ্টা করলাম।

আমার দ্বিতীয় পেগ চলছে এমন সময় টের পেলাম আমার পাশের লম্বা টেবিলে সেই ছেলে কয়টি বসেছে। বারেও তারা বেশ হইহল্লা করে কাটালো। তাদের কথায় বুঝতে পারলাম তারা কেউই ঢাকা কলেজের ছাত্র নয়। কেউ মিরপুর বাংলা কলেজের, কেউ একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবাই থাকে এক মেসে। আমি কখনও আকন্ঠ পান করি না। লিমিট ছাড়ার আগে আমি বার ছাড়লাম।
তার বেশ কয়েক বছর পরে আমিন বাজারে ঘটে এক বর্বরতম ঘটনা। সেই সময়ে নানা জন নানা ব্যখ্যা দিয়েছেন তাদের মতো করে। লিখে কলাম ভরে ফেলেছে পত্রিকার, টকশোতে টেবিল থাপড়ে সভ্যতা শিখিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু আমি বিষয়টিকে একটু ভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখার চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। বোঝার চেষ্টা করেছি খুনিদের মনস্তত্ব। উল্লেখ্য ঐ হত্যাকান্ডের সময় আমি আমিন বাজারের পাশেই বলিয়ারপুর নামক স্থানে বন্ধু মিজানুর রহমান সুমন এর সাথে থাকি। ঘটনার পর আমি স্থানীয় কবি বন্ধু সায়েম আফতাব এর সাথে বড়দেশী গ্রামে গিয়েছি। নানা পুলিশি বাধ্যবাধকতার মধ্যেও যতদূর সম্ভব স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছি বিষয়টি নিয়ে। সব দেখে

শুনে যা বুঝলাম তা হলো-
গাবতলী থেকে সাভার পর্যন্ত মূল রাস্তার দুইপাশের গ্রামের বেশীরভাগ পুরুষের পেশা কোননা কোন ভাবে পরিবহন খাতের সাথে জড়িত। ঢাকার অায়তন বাড়ার সাথে সাথে চড়চড় করে বাড়তে থাকে দুইপাশের জমির দাম। ফলে অনেকেই জমি বেঁচে বাস ট্রাক কিনেছে। কেউ কেউ আছে পরিবারের নারী সদস্য সহ এই পেশায় জড়িত। আয় ভালো। খুঁজলে হয়তো এমন অনেক গুলো পরিবার পাবেন যেখানে বাবা ড্রাইভার ছেলে হেলপার। নিজেদের ট্রাক কিংবা বাস, পারিবারিক বিজনেস। পরিবহন বিজনেজ অন্য অাটদশটা ব্যাবসার মতো নয়। এই বৈধ ব্যাবসাতেও থাকে মূহুর্তের মধ্যে খুন হওয়ার ভয় আবার খুন করার শঙ্কা। জীবন হাতে নিয়ে প্রতিদিন জিবিকার সন্ধানে নামে পরিবহন শ্রমিকেরা। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাদের মেজাজ আপনার আমার মতো ঠান্ডা থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। আমি হলপ করে বলতে পারি আপনি এমন কোন পরিবহন শ্রমিক পাবেন না যে জীবনে কমকরে হলেও একবার গনধোলাইয়ের শিকার হয়নি। পুলিশ কিংবা ঘাড়ত্যাড়া যাত্রির চড় থাপ্পর তাদের কাছে ডালভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐ রাতে নিহত ছয়জন ও আহত একজন ছেলে অত রাতে ঐ স্থানে কেন গিয়েছিলো তা আজও অস্পষ্ট। তবে তারা যে ঐ স্থানে নামাজ আদায় করতে যায়নি একথা মনে হয় আমরা মোটামুটি নিশ্চিৎ। তবে তারা যে ডাকাতি করতে যায়নি সে কথাও মোটামুটি নিশ্চিৎ। কিন্তু ঘটনাটি কি হয়েছে? খুন হয়েছে ছয়ছয়টি তাজা প্রাণ। মসজিদের মাইক মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্য, কল্যানের পথে ডাকার জন্য।

আমি লেখার শুরুতে যে ঘটনাটি বলেছি সেই ঘটনায় যে ছেলেগুলো বাসের কন্ডাকটরকে মেরেছিলো সেই ছেলে গুলো আর নিহত ছেলে গুলো এক নয়, আবার যে হেলপার ঐদিন মার খেয়েছিলো সেই হেলপারও হয়তো ঐদিনের হত্যাকান্ডের সাথে আদৌ জড়িত নয়। কিন্তু সব গল্পই তো গিয়ে দিন শেষে এক যায়গায় গিয়ে মিলিত হয়। উগ্র মেজাজ, হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য হয়ে যাওয়া, নিজের সুযোগ ব্যবহার করে অন্যকে বাটে ফেলে সাইজ করা। আমরা হয়তো অনেকে বলব যে বড়দেশী গ্রামের মানুষগুলো অশিক্ষিত ছিলো তাই তারা এমন করেছে। না আসলে তা না, তারা সুযোগ বুঝে একটা সম্প্রদায়ের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছে। হয়তো সেটা সবাই মিলে অালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি তবে ইন্ডিভিজুয়াল ক্ষোভ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো সেই ভয়াল রাতে। আসুন আমরা সবাই যে যার যায়গায় নমনীয় হই। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করি। কখনও যেন ভুলে না যাই আমরা সবাই মানুষ। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের সমান সম্মান রয়েছে। একজন বাসের ড্রাইভার আপনার কাছে হয়তো শুধুই দুই আনার মূর্খ ড্রাইভার, বাট কারো কাছে মহান পিতা, রোমান্টিক স্বামি। আমরা মানুষ হিসেবে সবাইকে সমান সম্মান দেব, সহনীয় হব এই হোক আমাদের অঙ্গিকার। সবাইকে ধন্যবাদ।

© মোটা দাগের কথা
সাইফুল বাতেন টিটো,

মিডিয়াকর্মী
১১ মে, ২০১৭

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...