ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - মহতী স্বপ্নের মৃত্যু নেই…

মহতী স্বপ্নের মৃত্যু নেই…

ডা. সৌমিত্র সিনহা রায় >>

আজ দুই দিন হলো সরকারী হাসপাতালের ডক্টরস কোয়াটারে উঠেছি। কিন্তু এই স্বপ্ন বুনেছি ২০ বছর ধরে।মাঝে মাঝে জীবন স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর হয়,তবে অনেক ধৈর্য্য আর পরিশ্রম করতে হয়।অনেক সময় তা ২০ বছরেরও বেশী……

আমার মা চাকরি করতো।সরকারি চাকরি। ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর মাঠকর্মী ছিলেন।মায়ের পোস্টিং ছিলো মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে ধানীসাফা ইউনিয়ন।প্রায় ২৫ বছর চাকরি করেছে ।এখন রিটায়ার্ড ।আমরা দুই ভাই।আমি ছোট্ট।ছোট্টবেলার কথা।ক্লাস থ্রি বা ফোরের দিকের ।

যখন মায়ের বেতন দেয়ার দিন আসতো,সেইদিন আমি আর আমার বড়ভাই ক্লাসে যেতাম না।মায়ের হাত ধইরা দুইভাই মিলে মায়ের সাথে অফিসে বেতন তুলতে যেতাম।অফিসের আঙ্কেল যখন বেতন দিতো তখন মায়ের হাতে দিতো না।আমার বা আমার ভাইয়ের হাতে দিতো।একমাস আমার হাতে,অন্যমাসে আমার ভাইয়ের হাতে।আমার ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী।ওর হাতে যখন অাঙ্কেল টাকা দিতো,তখন নতুন, ফর্সা আর কড়কড়ে নোটগুলা দিতো।এখনও সেই নোটগুলার গন্ধ পাই।কেমন যেন কড়কড়ে মিষ্টি গন্ধ।বেতন নিয়ে আসার পথে বেকারী দিয়ে মা নতুন গরম টোষ্ট বিস্কুট কিনে আনতো।আমরা চা দিয়া ভিজাইয়া খাইতাম।এককাপ চা তে হইতো না।মা আবার চা আনতো।একসময় বিস্কুট ফুরাইয়া যাইতো।আমাদের আবার মন খারাপ হইতো।আবার ১ মাস পর এতো বিস্কুট একসাথে খাইতে পারবো।

একদিন এরকম বেতন তুলে মায়ের সাথে বেকারী দোকানে বিস্কুট কিনতে গেছি।একজন ইয়াং বয়সের লোকও বেকারীতে বিস্কুট কিনতেছিল।মাকে দেখে সালাম দিলো।বাবার কথা জানতে চাইলো।আমার বাবা মফস্বলের হাইস্কুলের অংকের টিচার। কথাবার্তায় বুঝলাম,বাবার ছাত্র উনি।এখন ডাক্তার,নতুন পোস্টিং হইছে।তখনো বইপত্রে ডাক্তার লেখা দেখছি,এইম ইন লাইফ নামে ইংরেজী রচনাতে।জীবনে প্রথম ডাক্তার দেখলাম চোখের সামনে।আঙ্কেল উনার কোয়াটারে আমাদের নিয়ে গেলো।অনেক কিছু খাওয়াইলো।আসার পথে অনেকখানি আগাইয়া দিলো।বাসায় যাইতে যাইতে রাস্তায় মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, এই বাসার ভাড়া কতো ? ”
মা, অদ্ভূত একটা উত্তর দিলো। “এ বাসায় নাকি যে কেউ উঠতে পারে না,টাকা থাকলেও না।যারা ক্লাসে ফার্স্ট হইয়া ডাক্তার হইতে পারে,সরকার তাগো এইরকম সুন্দর বাসা দেয়।” আমরা তখন টিনের ঘরে থাকতাম।এইরকম বিল্ডিং এ থাকার ইচ্ছা জাগলো।বাসায় আইসা দুপুরে খাইতে খাইতে মা কে বললাম, ” মা, আমরা এইরকম বাসায় থাকতে পারি না?”…. মা বললো, “আমরা তো পারলাম না,তুই যদি ক্লাসে ফার্স্ট হইয়া, ডাক্তারি পইরা এরকম একটা বাসায় রাখতে পারিস….তাইলেই আমরা কেবলমাত্র থাকতে পারি….পারবি রাখতে…?” ….আমি কইলাম,” হুম,পারমু।” ওইদিন হেব্বি পড়ালেখা দিছিলাম।মনে হইতেছিল,একদিনেই কোয়াটার পাইয়া যামু..

যেদিন নটরডেম কলেজে ক্লাস শুরু হইছিলো,তার আগের দিন বাসে উঠাইয়া দিয়া, মা শুধু একটা কথাই বলছিলো, “ভালো মতো পড়ালেখা করিস কিন্তু, বাবা।নাইলে কিন্তু মাকে কোয়াটারে উঠাইতে পারবি না। ” কথাটা ভুলি নাই কখনো। জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে।এইকথাগুলা এখনো মনে পড়ে।কানের সামনে বাজে,চোখের সামনে ভেসে উঠে।স্বপ্ন দেখি এখনো, আমি এলাকায় ডাক্তার হইয়া যামু,মা কে নিয়া কোয়াটারে উঠমু।তারপর মার কানে কানে কমু,মা এই তোমার সাধের কোয়াটার।মা হাসবে।ওই তৃপ্তির হাসির দাম হিসাবে উঠবে না।

আর একটা জিনিসের স্বপ্ন দেখি, আমি বেতন পাইলে আবার বেকারী দিয়া গরম টোষ্ট কিনা দুইভাই মিলা চায়ে ডুবাইয়া খামু।অনেকদিন খাই না এভাবে।বেকারীর দোকানে আবার একটা ছোট্ট ছেলে আমাকে দেখে তার মাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনবে,জীবনে প্রথম ডাক্তার দেখার আনন্দে উদ্বেলিত হবে।আমার স্বপ্নগুলা হয়তো নেহাতই ছোটোখাটে, কিন্তু এগুলো বুনতেই অনেক সময় চলে গেছে।মা স্ট্রোক করে স্মৃতিশক্তি প্রায় হারানো অবস্থায়,ভাইয়ের মানসিক প্রতিবন্ধতার পাশাপাশি শারিরিক প্রতিবন্ধতাও দেখা গেছে।আমি জানি না,ওরা এগুলা ভুলে গেছে কিনা….?….কিন্তু মনে রাখছি আমি,মনের এককোনায় আটকে আছে স্মৃতিগুলো।

উপরোক্ত কথাগুলো একসময় স্বপ্ন ছিলো।

আমি এখন ৩৪ তম বিসিএস এ নিয়োগপ্রাপ্ত একজন ১ম শ্রেনীর গেজেটেড সরকারী কর্মকর্তা। পোস্টিং এখন আমার চিরচেনা সেই মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।যেখানে মায়ের কোলে,মায়ের হাত ধরে বেড়ে উঠা।ডাক্তার সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখা সেই জায়গা।ডাক্তার,সরকারি ডাক্তার,সরকারি কোয়াটারওয়ালা ডাক্তার।

সুন্দর হোক সবার আগামী দিনগুলার পথচলা।সবাই সরকারী চাকরীতে আসতে অনুপ্রাণিত হোক,নিজ নিজ এলাকায় সেবা দিক,দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাক।আপনি হয়তো জানেন না,শুধু আপনার মতো একজন ফার্স্টক্লাস গেজেটেড সরকারী ডাক্তার বা চাকুরীজীবীকে দেখে আশেপাশের কতো মানুষের জীবনের মোড় ঘুড়ে গেছে,কত্তো বাচ্চারা অনুপ্রানিত হচ্ছে….কত্তো মা-বাবারা স্বপ্ন বাধছে…?…আমিই এর উদাহরন,আমিও চেয়েছি এইরকম একজন হইতে।বেসরকারী চাকরীর কড়কড়ে স্যালারী আমাকে টানে না,আমিও চাই ওই বেকারীতে প্রথম দেখা কোয়াটার আলা ইয়াং ডাক্তার হইতে।স্বপ্ন আরও আছে,পথ অনেক বাকি এখনো। স্বপ্ন দেখতে দোষ নাই….মহতী স্বপ্ন দেখে যেতে চাই…

ডা. সৌমিত্র সিনহা রায়, মেডিকেল অফিসার

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...