ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - আপ্যায়ন

আপ্যায়ন

সাইফুল বাতেন টিটো >>
সতেরো দিন পরে একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট বাথরুমে ভিজিয়ে যখন রঞ্জু ভাতের মধ্যে একটা আলু দুইভাগ করে সিদ্ধ করতে দিলো ঠিক তখনই মোবাইলে নোকিয়া টোন বেজে উঠলো।
নাজমুল ভাই। গায়ের সবকটি পশম দাঁড়িয়ে গেলো। রিসিভ করলো না প্রথম। আবার নিজে নিজেই শান্ত হলো। এরপর কিছু সময় নিরব রইলো। রঞ্জু একশো পারসেন্ট নিশ্চিত যে নাজমুল ভাই টাকার জন্য ফোন করেছে। পাঁচ শ টাকা সে পাবে। দেড় বছর আগে সে রঞ্জুকে কুরিয়ার করে এক হাজার টাকা পাঠিয়েছিলো। পাঁচ শ টাকা আগেই রঞ্জু পেতো নাজমুরের কাছে। এর আগে যতোবার টাকার জন্য রঞ্জুকে ফোন করেছে তার বিল এক হাজার টাকার উপর হবে। আর ততোবারই রঞ্জু বলেছে
-ছি ছি! কি লজ্জার ব্যাপার দেখেন তো? কালও মনে করেছি আপনার টাকাটা পাঠিয়ে দেবো। ইশ—। ঠিক আছে আগামি কাল… নাহ আগামি কাল না পরশু মাস্ট টাকাটা কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেবো। আপনার আর ফোন করার দরকার নেই।
আবার ফোন বেজে উঠলো। রঞ্জু ভয়ে ফোন থেকে দূরে সরে এলো। থেমে গিয়ে আবার বেজে উঠলো। আবার।
এবার আর রিসিভ না করে পারলো না রঞ্জু।
-হ্যালো স্লামালিকুম নাজমুল ভাই, কেমন আছেন? ছোটো ভাইদের মনে আছে?
-ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
-জ্বী ভালো, আপনি কোথায়?
-আমি বাস স্ট্যান্ডে, তুমি কোথায়?
-বাসায় রান্না করছি।
-চাল কয়টা বেশি দাও আমি আসতেছি তোমাদের বাসায় বেড়াতে।
কথাটা শোনার সাথে সাথে রঞ্জুর হার্টবিট বেড়ে একশোর কাছাকাছি চলে গেলো। গলা শুকাতে শুরু করলো। আল্লাহ একি গজব? ও যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো।
-আরে ধুর চাপা মাইরেন না তো! আপনি আসবেন আমাদের বাসায়? এই সৌভাগ্য আমাদের জীবনেও হবে না। চাপা বাদ দেন, বলেন কোথায় যাচ্ছেন? বাস স্ট্যান্ডে ক্যান?
-তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলা না? আমি সিল্ক লাইন বাস স্ট্যান্ডে। ঢাকার বাসে উঠবো। ১১টার দিকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে যাবো। কমছে কম পাঁচ দিন থাকবো তোমাদের সাথে। ঘুরবো, মজা করবো বিলিভ মি।
প্রচণ্ড কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে রঞ্জু বললো
-সত্যি নাজমুল ভাই? সত্যি আসবেন? তাহলে মনে হয় না আমার চেয়ে বাংলাদেশে আজ আর কোনো খুশি লোক আছে।
-হে হে হে…আচ্ছা রাখো। আমি বাসে উঠে কল দিবো। এখন মোবাইল রাখতে চাইতেছো না প্রথম তো ধরলাই না।
-ধুর কি যে বলেন? আপনার কল ধরবো না। আমি বাথরুমে ছিলাম। মাইন্ড করছেন?
-আরে না মাইন্ড করি নাই আমি বুঝতে পারছি তুমি মোবাইলের কাছে নাই। এমনি বললাম কথাডা। আচ্ছা রাখো, আল্লাহ হাফেজ।
ওপাশ থেকে লাইন কাটার পর রঞ্জু যেখানে দাড়িয়ে কথা বলছিলো সেখানেই বসে পড়লো। মাথা ঘুরছে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে। কিছু সময় পরে উঠে বাথরুমের ট্যাপ খুলে তার নেচে মাথা পেতে ৫/৭ মিনিট বসে থাকলো। হঠাৎ ভাতের কথা মনে পড়তেই দেখে মাথা খারাপ হবার যোগার। ভাতও প্রায় হয়ে এসেছে। ভাতের গুল্লি মার। সামনে কেয়ামত আসতেছে। কি করা যায়? উফ! এই মুহুর্তে মানিব্যাগের গোপন কুঠুরিতে একটা চকচকে ১০ টাকার নোট আর একটা চকচকে এক টাকার নোপ ছাড়া একটা শিকিও নেই। অথচ প্রায় হাজার খানেক টাকা খুব খুব দরকার। যে কোনো মূল্যেই হোক। কি করা যায়।
রঞ্জু আবার একগ্লাস পানি খেলো। মোবাইলে আছে এগারো টাকা চুরাশি পয়সা। সাকিব আউয়াল এই দুই হারামির কাছেও কানাকড়িও নাই। থাকলে কোনো সমস্যাই ছিলো না। কিন্তু আসলেই যে নাই তা রঞ্জু খুব ভালো করেই জানে। সাকিব গতো তিন দিন ধরে তার গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে না। ওর গার্লফ্রেন্ড কল দিলে ও কেটে দেয়। আর তা নিয়ে ওর দুঃখের অন্ত নাই। সাকিবের মোবাইলে গতকাল পর্যন্ত ব্যালেন্স ০.২৮ টাকা। সাকিব-আউয়ালের কথা মনে হতেই সাকিব চলে এলো।
-সাকু দোস, আমারে বাঁচা।
-ক্যান কি হইছে?
-দাড়া ভাত উঠাইয়া লই, পরে কইতেছি।
রঞ্জু ভাত উঠাতে গিয়ে মাড়সহ একতৃতীয়াংশ ভাত ফেলে দিলো। হয়তো হাতও পুড়েছে। রুমে গিয়ে দেখে সাকিব হাত পা ছড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। রঞ্জুকে দেখে বললো
-কি হইছে দোস? বলতো শুনি! রঞ্জু হাত মুছতে মুছতে সাকিবের পাশে বসলো।
-দোস্ত নাজমুল ভাই আসতেছে!
-কোন নাজমুল? আমাগো নাজমুল ভাই? আমগো লগে থাকতো? এহন ব্রাকে বড় চাকরি করে সেই নাজমুল ভাই?
-আরে হ।
-আসতেছে তো কি হইছে?
-ফোন করছিলো একটু আগে, আইতেছে, কইছে ৫ দিন থাকবো। হ্যারে রাখমু কই, খাওয়ামু কি? তার উপর হ্যায় আমার কাছে ৫০০ টাকা পায়।
-ইয়া মাবুদ তুই কি কস? সাকিব শোয়া থেকে উঠে বসলো।
-এখন বোঝ আমার কি অবস্থা? তোর কাছে কি কোনো ব্যবস্থা আছে? হাজার খানেক টাকার ব্যবস্থা করতে পারবি? তোর তো অনেক খালা, ফুপি আছে গিয়ে দেখ না, কিছু হয় নাকি?
সাকিব দুই হাত জড়ো করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো
-দোস্ত, মাফ চাই। প্রয়োজনে ভিক্ষা করুম, হ্যাগো কাছে যামু না।
-আচ্ছা একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।
-দাড়া চিন্তা করতেছি, আউয়াল কই মামা?
-জানি না। তুই কি শুইয়া শুইয়া চিন্তা করবি? এখন বাজে শোয়া পাঁচ টা, নাজমুল ভাই দশটার মধ্যে আসতেছে। যা করার এখনই করতে হবে।
-তোর কাছে কোন সিস্টাম নাই?
-ধুর ফালতু কথা কইস না তো! আমার কাছে থাকলে অ্যাতো প্যান প্যান করি?
-আচ্ছা দেখি, বন্ধু বান্ধব কে আছে টাকা দেওয়ার মতো। চিন্তা কর তো?
-তোর ফোনে টাকা আছে?
-আছে এগারো বারো টাকা, ক্যা?
-রেভেনরে একটা ফোন দে তো?
-ওরে ফোন দিয়া লাভ আছে? ওর কাছে টাকার কথা কইলে ও কইবে-“দোস আমার কাছে তো গতকালও দশ হাজার টাকা ছিলো ওমুক ধার নিয়া গেছে। গতকাল চাইলে পাইতি”। ও একটা আস্ত ধুরন্ধর। থাকলেও দিবে না।
-আরে বলা যায় না, দিতেও পারে। আমারে একবার দুই হাজার টাকা দিছিলো।
-আচ্ছা ফোন দিতাছি।
রঞ্জু ফোন হাতে নিয়ে টেপাটেপি শুরু করলো।
-হ্যালো রেভেন দোস্ত ক্যামোন আছিস?
-হ ভালো, তোরা কেমন আছিস?
-এই তো মোটামুটি।
-দোস্ত মজার খবর কি জানিস? আমার ছাত্রীগো জ্বালায় মেক্সিমাম সময় ফোন বন্ধ রাখতে হয়। আরে মাইয়াগুলা কি পাজি! যা গরম গরম এসএমএস পাডায় দেখলে তোর মাথা গরম অইয়া যাইবো। তুই না দেখলে বিশ্বাসই করবি না। একদিন আয় আমার মেসে দেহামুনে। তুইও গরম হইয়া যাবি। আবার শোন সেদিন কি হইছে…
-রেভেন দোস্ত শোন আমি বিশেষ একটা সমস্যা নিয়া তোরে ফোন দিছি। সংক্ষেপে কই শোন।
-ক ক তোর সমস্যা কি, ঢাকার শহরে সমস্যা কি তোর কোনো সমস্যা নাই। রেভেন কি মরছে? আমি আছি না! তুই ক কি সমস্যা।
-দোস্ত আমার হাজার খানেক টাকা দরকার।
-হ্যালো হ্যালো। রেভেন সব কথা শুনও হ্যালো হ্যালো করতে লাগলো।
-হ্যালো হ্যা রেভেন শুনতে পাচ্ছি তো!
-হ্যালো, ধুর কিছুই শোনা যায় না, হ্যালো, ধুর, কি যে নেটওয়ার্ক, হ্যালো। আরে ধুর ছাই।
রঞ্জু বিরস মুখে সাকিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-রেভেন কাইটা দিছে। বলতেছে নেট প্রবলেম, কিছুই নাকি শোনা যায় না।
-হ আমি জানি রেভেনের কাছে টাকার কথা বললে ও কিছু শোনে না। রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল সাকিব।
-আচ্ছা দেহি কি করা যায়। দেখতো তোর মোবাইলে কতো টাকা আছে?
জানতে চায় রঞ্জু।
-এক টাকা এগারো পয়সা।
-আচ্ছা ঘর দুয়ারের যা অবস্থা নাজমুল ভাই কি মনে করবে? রুম বাথরুমের যা অবস্থা, নাজমুল ভাই এহানে কি কইরা থাকবো? এগুলা পরিস্কার করতে হবে।
-ঠিক। নাজমুল ভাই আগে থেকেই এসব অপরিস্কার বাথরুম, ময়লা ফ্লোর, মাকড়শার জাল একদম পছন্দ করে না। এহন তো বড় চাকরি করে। চল এইগুলা পরিস্কার করি।
-চল-
দুজনে মিলে সব পরিস্কার করতে লাগলো। মাকড়শার জাল, ভাঙা জানালার গ্লাস মোছা, বাথরুমের প্যান, ফ্লোর সব। গেস্ট আসছে, যেই সেই গেস্ট না নাজমুল ভাই বলে কথা। এমনিতে ওরা তেমন পরিস্কার টরিস্কার করে না। করে না বলতে করার সময় কই? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি ছেলেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রচণ্ড প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়। ওরা যেখানে থাকে সেখানে আসলে কোনো ভাড়া দিতে হয় না। ভাড়া না দিলেও আবাসটা বেশ ভালো। যায়গাটা সাকিবের চাচার গোডাউন ঘর। বেশ বড় একটা বাড়ি। সেখানে সাকিব একটা থাকার জন্য একটা রুম পেরেয়ছে। আাউয়ালদের বাড়ি সাকিবদের বাড়ির একদম পাশে।যার জন্য আউয়াল থাকে অন-রিকোয়েস্টে। আর রঞ্জু পুরোপুরি অবৈধ।
নাজমুল আবার ফোন করলো।
-হ্যা নাজমুল ভাই, বলেন, এখন কোথায়?
-কোথায় বলতে পারবো না, বাস খুব জোরে চলছেতো বোঝা যাচ্ছে না। আচ্ছা আমিতো তোমাদের বাসা চিনি না; যাবো কিভাবে?
-আপানি ঢাকায় নাইমা একটা ফোন দিয়েন। আপনার বাস কোথায় থামবে?
-সম্ভবত সায়দাবাদ।
-সমস্যা নেই, আপনি আমারে একটা ফোন দিয়েন, রাখলাম।
ফোনটা পকেটে রেখে রঞ্জু সাকিবকে বললো
-নাজমুল ভাই আবার ফোন করছিলো, কি করি বলতো?
-অ্যাত্তো চিন্তা করিস না তো আউয়াল আসুক একটা ব্যবস্থা হবেই।
-আউয়াল করবে ছাই। চল রক্ত বেচি!
-পাগল হইছো? প্রয়োজনে ভিক্ষা করুম। উল্টা পাল্টা কথা কইস না।
-তুই ফালতু কথা বলিস না। টাকার সমস্যাটা কতো প্রকট তু্ই বুঝিস?
-না আপনি একা বোঝেন।
-আচ্ছা বল তুই কি সত্যি সত্যি ভিক্ষা করতে পারবি?
-আরে ওটাতো কথার কথা।
-এজন্যইতো বলেছি তুই টাকার সমস্যা বুঝিস না। সময় আছে ৩/৪ ঘণ্টা আর তুই কথার কথা বলিস। এখন কথার কথা বলার সময় নেই। কাজের কথা বলতে হবে। আমি সত্যিই রক্ত বিক্রি করবো।
-আর ইউ সিরিয়াস?
-অফ কোর্স সিরিয়াস! সমস্যা কি? আরিফতো কইছেই প্রতিটা সুস্থ মানুষ যার বয়স ১৮ থেকে ৫৮’র মধ্যে সে প্রতি ৩ মাস পর পর রক্ত দিতে পারে। সো, সমস্যা কি? এতে নাকি বরং উপকার হয়। তুই চেতিস ক্যান?
-তোর রক্ত তুই যা করিস।
-দোস্ত আমাগো আর উপায় নাই।
-ঠিক আছে শাহবাগ চল। একটা কিছুতো করতে হবে।
-দোস্ত কতো পাওয়া যাবে? হাজার খানেক দেবে?
-জানি না। কবির ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে।
-কবির ভাইটা কে?
-আছে, দালাল।
-তুই চিনিস ক্যামনে? তুই আগে বিক্রি করছিস নাকি?
-প্যাক প্যাক করছিস ক্যান? আমি রক্ত বিক্রি করবো ক্যান?
-তাইলে কবির ভাইকে চিনিস ক্যামনে?
-তোর কি টাকা দরকার না কবির ভাইকে ক্যামনে চিনি সেইটা বেশি জানা দরকার?
-টাকা দোস্ত টাকা।
-তাইলে চল।
সাকিব আর রঞ্জু শাহবাগের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলো। নাজমুল ওদের হৃদয়ের এতো বেশি জায়গা জুড়েই আছে যে তার জন্য ওদের রক্ত বেঁচতেও কোনো দ্বিধা নাই।
আজ থেকে বছর ছয়েক আগে ওরা তিনজন যখন ঢাকায় কোচিং করতে আসে তখন প্রথম নাজমুলের মেসেই ওঠে ওরা তিনজন। এরপর ওদের তিনজনকে বেশ আপন করে নেয় নাজমুল। তখন ওরা বাড়ি থেকে টাকা পয়সা আনতো। আর তখন নাজমুলের চলছে আগুনের দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিউশন করা, কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়া, পার্ট টাইম চাকরি খোঁজা, এক্সপেরিয়েন্স তৈরির জন্য জার্মান কালচার, রাশিয়ান কালচার, থিয়েটার করা কতো কি!
সারাদিন কষ্ট স্ট্রাগল। একটা সময় নাজমুল ওদের কাছে বিভিন্ন বিষয় মিলে মহানায়কে রুপ নিলো। নাজমুল বলতেই ওরা বেঁহুশ। তখন ওদের মধ্যে একটা গাঢ় ভালবাসাও ছিলো। একসময় ওরা ভর্তি হলো। রঞ্জু ঢাকা কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে সাকিব আর আউয়াল তিতুমীর কলেজে। একজন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং আর একজন অ্যাকাউন্টিং। আস্তে আস্তে ওদের বাড়ি থেকে টাকা আনা বন্ধ হয়ে গেলো। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল জীবনের হাতছানিতে ওরাও হয়ে উঠলো পরিশ্রমী। আর সেক্ষেত্রে নাজমুল ওদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। এমনকি নিজের টিউশন পর্যন্ত ওদের দিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও আরও টিউশন খুজে দেওয়া, কোচিং সেন্টারে বড় ভাইদের সাথে ভালো রিলেশন তৈরি করে দেওয়া, মাস শেষে টাকা পয়সা দিয়ে হেল্প করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই থেকেই নাজমুল যেনো নিয়মানুযায়ী ওদের কাছে মহানায়ক হয়ে গেলো। নাজমুলকেও যে ওরা হেল্প করেনি তা না। অসুস্থ হলে শুশ্রষা করা টাকা পয়সা ধার দেওয়া, ওর কোনো গেস্ট কে নিয়ে ঘোরা বা সময় দেওয়া, এমনকি ওদের জামা কাপড় পর্যন্ত একটা সময়ে নাজমুল পরতো। এক সময় এরকম অবস্থা হলো যে ওরা একে অপরকে ছাড়া প্রায় অচল। এমনকি প্রত্যেককে প্রত্যেকের অধিকার মনে করতে লাগলো। বছর তিনেক পরে নাজমুলের অনার্স শেষ হয়ে গেলো। এবার চাকরি খোঁজার পালা। এই ফার্ম, সেই ফার্ম, বিসিএস, প্রাইমারি স্কুল, আর্মির এডুকেশন অফিসার এরকম আরো কতো দৌড়াদৌড়ি। অ-ফেরতযোগ্য ব্যাংক ড্রাফ্ট করতে করতেই সে সময় মাসে ওর প্রায় ২/৩ হাজার টাকা লাগতো। উপরন্তু তখন বেশি টিউশনও ছিলো না। একটা সময় নাজমুল ওদের উপর নির্ভর করতে শুরু করলো।
একদিন নাজমুল বেশ বিষন্ন মনে এসে বললো
-সবাই শোন্, আমার একটা চাকরির ইন্টারভিই কার্ড এসেছে। চাকরি হবার সম্ভাবনা শতকরা ৯৫ ভাগ কিন্তু হবে না।
সকলে একযোগে বলে উঠলো
-ক্যা?
-কেন আবার কি, ইন্টারভিউ দিতে পারবো না।
রঞ্জু বললো্,
-ইন্টারভিউ দিতে সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা কোথায়? সমস্যা চিটাগং। মানে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে চিটাগং। পকেটে আছে মাত্র ছয় টাকা। আর হিসাব করে দেখলাম সবমিলিয়ে লাগবে দুই হাজার টাকা। এই মুহুর্তে দুই হাজার টাকা পাবো কোথায়?
সবার মুখে যেনো কেউ কালির দোয়াত ঢেলে দিলো। আউয়াল বেশ সাহস করে বললো
-কবে যাবেন?
-সাত তারিখ, আট তারিখ সকাল নয়টায় ইন্টারভিউ। আমাগো আল্লায় সব দিক দিয়া ফকির বানাইছে। সবারই চিটাগঙের মতো বিভাগীয় শহরে যেখানে একটা আন্তর্জাতিক পোর্ট আছে সেই শহরে দুই একজন আত্মীয় স্বজন থাকে। আমার লতায় পাতায় পেচানোও কোনো আত্মীয় চট্টগ্রামে নাই। থাক তোরা মন খারাপ করিস না।
আউয়াল আবার বললো
-আপনি পাচশ টাকা জোগাড় করেন, আজতো দুই তারিখ। দেখি কি করা যায়। কিরে তোরা কি বলিস?
সমর্থনের আশায় ওদের দুজনের দিকে তাকালো আউয়াল।
-তোরা দুইজন মিলে এক হাজার টাকা দিতে পারবি না?
রঞ্জু নিমরাজি হয়ে বললো
-দেখি পারবো মনে হয়।
সাকিব তেমন উৎসাহ দেখালো না। নাজমুলের চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো।
শেষ পর্যন্ত আউয়ালের কথামতোই কাজ হলো। নাজমুল সাত তারিখ সকালে সায়দাবাদ থেকে চিটাগঙের বাস ধরলো। মেস থেকে বের হবার সময় বললো
-আমি জানি তোমাগো টাকাডা দিতে বেশ কষ্ট হইছে। তয় একটা জিনিস মনে রাখবা, চাকরিডা আমার কনফার্ম; আর আমার চাকরি মানে তোমাগোও একটা সুব্যবস্থা। আমাগো এইডাতো একটা সংসার। আর সংসারের এক পোলার চাকরি হইলেতো অন্যগো কষ্ট একটু কম হয়। চিন্তা কইরো না।
এই ছেলে তিনটা কি নাজমুলের কাছে আসলে কিছু আশা করে? না করে না? কি জানি!
নাজমুল ইন্টারভিউ দেয়ার পর:
গতো দুই দিন ধরে সাকিব ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এমনকি নাজমুল চিটাগং যাওয়ার সময়ও বাসস্ট্যান্ডে যায়নি। খালি বলছে শরীর দুর্বল, শরীর দুর্বল। আবার বলে আমার বেশ কিছু দিন পুষ্টিকর খাবার খাওয় দরকার। বেশ পানি টানি খাচ্ছে। কি হয়েছে কে জানে?
তবে আউয়াল কিছু একটা সন্দেহ করছে।
আউয়ালের এক ছোটো ভাই গতো একবছর হলো ঢাকায় এসেছে। আউয়াল বাড়ি থেকে টাকা পয়সাতো আনেই না উল্টো আরো ছোট ভাইকে মাসে মাসে পাঁচশ টাকা করে দেয়। গতকাল ওর ছোটো ভাই এসেছিলো। আউয়ালের কাছে টাকা চায়নি। কখনো চায় না। প্রতিবারই আসার পর ১৫-২০ মিনিটের মাথায় দিয়ে দেয়। গতকাল এসে ঘণ্টা খানিক বসে ছিলো। আউয়াল একবার এসে দেখা করেছে আর ওর সামনে আসেনি। যাওয়ার সময় এর ছোট ভাই করুণ মুখে বললো
-দাদা যাই
আউয়াল অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
-আচ্ছা। তবে কণ্ঠটা কেমন জানি ভারভার লাগছিলো।

সাকিব কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছে রঞ্জুর বইয়ের র‌্যাকটা খালি। ওর চার সেলফের একটা বাঁশের র‌্যাক আছে। সেখানে রাজ্যের যতো গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ সহ নানা বইয়ে ঠাসা। রঞ্জু চেষ্টা করে নতুন হোক পুরাতন হোক প্রতি সপ্তোহে বই কেনার। সাকিব একদিন জিজ্ঞেস করেছিলো
-পুরাতন বইগুলো কই পাইস? চুরি করিসনাতো আবার?
-ক্যা সবাইরে তোর মতো চোর মনে করিস নাকি?
-না সাধুজী। বলেন কোথায় পান?
-তুই জগৎ সম্পর্কে কোনো খবর রাখিস? নীলক্ষেতে নতুন পুরাতন সব বই পাওয়া যায়। তুই ইচ্ছা করলে তোর পুরাতন বই বিক্রিও করতে পারবি।
রঞ্জু কি তাহলে ওর অ্যাত্তো সখের বইগুলো শেষ পর্যন্ত…….???
যাই হোক আজ আবার সেই নাজমুল ভাইয়ের আপ্যায়নের জন্য টাকা সংগ্রহ করতে রক্ত বেঁচতে এসে হাসপাতালের এক চিপায় সাকিব রঞ্জুকে দাঁড় করিয়ে কবির ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর মলিন মুখে ফিরে এলো।
-কি কবির ভাইরে পাস নাই?
-পাইছে, কাজ হয় নাই।
-ক্যান?
-আরে ফাডা কপাল আমাগো।
-ক্যান কি ব্যাপার?
-হে কয় অন্য কথা। কয় এহন রক্ত কেনার কোনো লোক নাই। এক জনের লাগবে এবি পজেটিভ। তোর তো ও পজেটিভ। অনেক কচলাকচলির পর কইলো, এক ব্যাগ ও পজেটিভ নিতে পারে তয় একশ টাকা দিবো।
কি ১০০ টাকা ! দরকার নাই দোস চল, অন্য চিন্তা করি।
-আর কি করা যায় মাথায় আসছে না
– চল আগে বাসায় চল।
দুজন আবার হেঁটে-ই বাসায় এলো। রঞ্জু এক গ্লাস পানি খেয়ে বলল
– এখন কি করা যায় বলতো সাকু ?
– আউয়াল মামা কই ? ওর মাথায় অনেক ক্রিটিকাল বুদ্ধি আছে ও আসলে একটা ব্যবস্থা বের করতে-ই পারবে।
– আছে কোথায় ও ?
– এক কাজ কর রাকিব রে একটা কল দে তো ।
– রাকিব দেবে?
– থাকলে দেবে না কেন ? ও তো আবার পার্ট টাইম জব করে। চাপা তো মারে ৭০০০ টাকাপায়।
– আমার মোবাইলে তো টাকা নাই। তোর কাছে টাকা থাকলে চল বাহির থেকে ফোন করি। বাইরে এসে সাকিব ফোন করল
– হ্যালো আমি সাকিব, কেমন আছিস ?
– ভাল তুই কেমন আছিস ?
– ভাল।
– দোস তুই ফোন করছিস ভাল হইছে, আমি-ই একটু পর ফোন করতাম। দোস আমার শ’পাচেক টাকার দরকার।
সাকিব লাইন কেটে দিয়ে বির বির করে বলল
– হারামজাদা । রঞ্জু বলল
– কি হইছে গালি দ্যাস কেন ?
– আরে হারামজাদা উল্টা টাকা চায়।
– থাক বাদ দে।
– না তুই চিন্তা কর কত্ত বড় হারামজাদা !
– আচ্ছা আরিফ ডাক্তার রে একটা ফোন দিবি ।
– ওর চিন্তা অনেক আগে-ই বাদ দিছি। ও আগেই আমার কাছে ৭০০ টাকা পায়।
– দেখ আউয়াল আসে নাকি।
– বাদ দে। আয়োজনের সময় তার রাত্রেও ক্লাস থাকে।
– তুহিনরে একটা ফোন দিলে কেমন হয় ?
– কোন তুহিন তোর ছোট ভাই ?
– হ্যাঁ।
– না না কোন দিনও না। হঠাৎ রঞ্জু বলল
– ঐ দেখ মামা টিভি দেখতাছে
– যা, হালার পুতের পাছায় একটা লাথি মার,
সাকিব সত্যি সত্যি আউয়ালের পশ্চাৎ দেশে সজোরে এক লাথি বসিয়ে দিল। আউয়াল হঠাৎ বেশ চমকে গেল। সাকিব বলল
– সারাদিন কই ছিলি বলদ ? আমরা মরতাছি হুতাছে। উনি টিভি দেখতেছে। সাকিব আর একটা মারতে উদ্যত হল। আউয়াল বলল
– কি হইছে মামা থাম থাম, কি হইছে ? রঞ্জু বলল
– ১০০০ টাকা দরকার এই মূহুর্তে।
– কোন ব্যাপার ? তা হঠাৎ ১০০০ টাকা বিষয় কি ?
সাকু টাঙ্গাইল যাবে নাকি আবার ? সাকিব কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল
-আর এক লাথি খাবি। বাসায় যেতে যেতে ওরা দুজন সব খুলে বলল। সব শুনে আউয়ার বলল
– এতো দেখতেছি কঠিন প্যাঁচ। রঞ্জু বলল
– সেই কঠিন প্যাঁচ খোলার জন্য-ই তো আপনাকে খোঁজা হচ্ছে জনাব ‘‘ক্রিটিকাল বুদ্ধির মামা”
– দাড়া মামা চিন্তা কইরা দেখি। কোচিং এ তসলিম ভাইয়ের কাছে ২৭০০ টাকা পাই। দাড়া হ্যারে একটা মিসড কল দিয়া দেহি। এর মধ্যেই রঞ্জুর মোবাইল বেজে উঠল।
– হ্যাঁ নাজমুল ভাই বলেন, কোথায় এখন ?
– কুমিল্লায়। শোন আমি কলা বাগান নামব, বুঝছে ?
– হ বুঝছি। কলা বাগান নাইমা আপনে রিকশা নিয়া আওলাদ হোসেন মার্কেটে আসবেন।
– ও তোমরা আওলাদ হোসেন মার্কেটে-ই থাক ?
– হ
– আমি চিনিতো, আচ্ছা রাখ। রঞ্জু আউয়ালের দিকে তাকাল।
– কি অবস্থা তসলিম ভাইরে পাইছ ?
– হ্যার মা অসুস্থ হইয়া পরছে। বিকেলে হে দুই দিনের জন্য বাড়িতে গেছে।
– দেশের বাড়ি থাক আর বিদেশে-ই থাক নাজমুল ভাই এহন কুমিল্লা। আউয়াল হঠাৎ তুড়ি বাজিয়ে বলল
– একটা বুদ্ধি পাইছি মামাা। অন্য দুজনের চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল।
– কি বুদ্ধি মামা ? রঞ্জুর চোখ মুখে চাপা উত্তেজনা।
– তবে কাজটা বেশ ঝুকিপূর্ণ।
– আরে পাঠা কাহিনী করিস না খুইলা ক। সাকিব মনে হয় রাগে একদম ফেটে পড়ছে।
– শোন, আমাদের বাসার সামনে যে ওভারব্রীজটা আছে, তার এপারে একটা ওপারে একটা মোট ২টা দান বাক্স আছে যদি কোন ভাবে ভেঙে নেয়া যায় তাহলে অনেক মাল পাওয়া যাবে। সাকিব তুড়ি বাজাল
– গুড আইডিয়া, আমার মাথায়ও ঠিক এই চিন্তাটা ছিল, শুধু সাহস করে বলিনি। আউয়াল সাকিবের মাথায় গাট্টা মেরে বলল
– বক বক করিসনা চাপ বাদ দে গ্রেট। তোর মাথায় তো সব সময় সব প্লান এসে গিজ গিজ করে কিন্তু আমি বলার পর সেটা ফ্লাস হয়। তুই থাম। আউয়াল আবার নতুন করে শুরু করল-
– কাজটা করতে হবে রাত্রী একটু বেশী হলে। কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে। এমন কি ধরে পুলিশেও দিতে পারে। পাবলিকের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বেশ মারাত্মক। এমনিতে দেখা যায় ঘুষ খেয়ে ১০ তলা বিল্ডিং বানাইছে বা মসজিদের ফ্যান চুরি কইরা ব্যাচতাছে, তাতে কিছু আসে যায় না। বাট এসব কাম দেখলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়া ফেলবে। যা করার সাবধানে করতে হবে।
– আমার মনে হয় না ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে। মিনমিন করে বলল রঞ্জু। ও জানে আউয়ালের কথার উপরে কোন কথা বলে লাভ নেই।
– আচ্ছা কেন ঠিক হচ্ছে না সেটা আমাকে সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা দেতো। তোর ব্যাখ্যায় আমি সন্তুষ্ট হলে জীবনে আর কোনো দিন কোন ওভারব্রীজে উঠবো না। বলে আউয়াল এমনভাবে বুকে হাত বাঁধল যে ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রতি পক্ষকে হারাতে সে তার সঠিক অস্ত্রটি-ই ব্যবহার করেছে। সাকিব চুপচাপ। রঞ্জু আবার বলল
– ওটা একটা দান বাক্স ওটা খেলে পাপ হবে।
– শোন ওটা যে দান বাক্স সেটা কি আমি জানি না ? আর আমরা কি এখন কম অভাবি ? ঠিক আছে তোর মনে যদি এত-ই পাপ বোধ জেগে থাকে তাহলে যখন বড় চাকরি টাকরি পাবি তখন কোন দান বাক্সে ঐ পরিমাণ বা তার বেশী টাকা দান করে দিবি। তাহরে-ই তো হল।
– ঠিক আছে উপায় যখন নাই তখন———- চল।
– চল মানে ? ধরা খাবা চান্দু ধরা খাবা, রাইত আরও বেশী হউক।
– ঠিক আছে
– আচ্ছা এখন একটা বিকল্প কিছু একটা ভাবি। রাত্রতো এখনও বেশী হয় নাই। সাকিব একটা প্রস্তাব দিল
– মামা শোন আমি একবার ফুটপাতে ৫০০ টাকা কুড়াইয়া পাইছিলাম। এক কাজ করি, আমরা ৩ জন নিচের দিকে তাকাইয়া হাটতে থাকি, বলা যায় না ৫০০ টাকার ২/৩ টা নোট পাইয়াও যাইতে পারি। আউয়াল বেশ চড়া মেজাজে বলল
– তোর হিমু গিরি বাদ দিবি ? ইস উনি রাত দুপুরে রাস্তায় রাস্তায় হাটবে আর ৫০০ টাকার বান্ডিল পাবে।
– আচ্ছা আউয়াল তুই প্রত্যেকটা ব্যাপারে এত ক্ষ্যাচ ক্ষ্যাচ করিস কেন বলতো ? মনে হচ্ছে রঞ্জু ও বেশ ক্ষেপে গেল
– ও কথাটা কইছে ঠিক আছে। তাতে তোর রাগ করার কি আছে ? তোর তো যাইতে ইচ্ছা না করলে ঘুমাগা। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই মিলে হাটা শুরু করল। বাস্তবে দেখা গেল আউয়াল-ই বেশী অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে হাঁটছে। তার প্রমাণ মিলল যখন সে ২ টাকার ছেড়া নোট পেল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাঁও পর্যন্ত চলে এলো। রঞ্জু-ই এক সময় বিরক্ত হয়ে বলল
– তোরা তো হিমুর মত-ই হাঁটছিস। আমি আইজ অনেক হাঁটছি আমার হাটুর গ্রীজ শেষ। সামনে গজব মনে আছে তো ? আউয়াল স্বতস্ফুর্ত হয়ে বলল
– আছে মামা আছে। মনে কর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ঘড় চিন্তা উড়কান্নাকাটি। আনন্দের কান্নাকাটি। সাকিব সুযোগ পেয়ে বলল
– তুই কি ভাবে ড়াবৎ শিওর হইলি যে কাজটায় মাস্ট সফল হবি-ই।
-শোন আউয়াল কোন দিন কোন কাজে ব্যার্থ হয়নি।
– তার মানে এর আগেও তুমি দান বাক্স ভাংছ মামা সাকিব মুখ টিপে হাসছে।
– যাই মনে কর। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ঋউঈপার হয়ে গেল। রাত্র সাড়ে আটটার মত বাজে। হঠাৎ রঞ্জু বলল
– চল একটু বেগুন বাড়ী থাইক্যা ঘুইরা আসি ?
– ক্যা ? সাকিব আউয়াল দুইজনে একত্রে বলল।
– আমার এক পরিচিত কাকা থাকে ওখানে। মোহাম্মদ আলী কাকা।
– তোর আপন কাকা ? আউয়ালের গলায় সন্দেহ।
– আরে না পাতানো। বাড়ী চিটাগং।
– কি করে ?
– ঋউঈ’ র পিওন।আমারে খুব ভালবাসে। মনটা বেশ উদার। চিটাগং এর লোক যে কত্ত উদার আর ভাল মানুষ ওনারে দেখলেই বুঝতে পারবি।
চল। সাকিব বলল
– টাকা দেবে কিনা বল। টাকা দিলে যাব।
– শোন থাকলে মোহাম্মদ আলী কাকা থাকলে আমাকে মাস্ট দিবে। তিন জনের দলটা এক সময় বেগুন বাড়ী বস্তিতে পৌঁছাল। অন্তত ১০ টা চিপা গলি ঘুরে অবশেষে ওরা মোহাম্মদ আলী চাচার ঘরের সামনে থামল। সাকিব নাক সিটকে বলল
– রঞ্জু আমি এই প্রথম বস্তিতে আইলাম। দোজখ কি এর চাইতেও খারাপ ?
– সাকু মুখে স্কচ টেপ মেরে দেব হারামজাদা। কেন এখানে যারা থাকে তাদের কি মানুষ বলে মনে হয় না। যারা এই ঢাকার জন্য আসলে কিছু করে তারা-ই এই সব বস্তিতে থাকে। তুই কি করিস ? এখানকার লোকগুলো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অ-মানসিক পরিশ্রম করে। কেউ গার্মেন্টস কর্মী, কেউ ভ্যান চালায়, কেউ ঠেলা গাড়ী, কেউ ইট ভাঙে, কেউ রং মিস্ত্রী, কেউ বই বাধাই করে, কেউ বা সিনেমার প্রোডাকশন বয়, সবাই সৃষ্টিশীল কাজ করে। তোর মত কেউ লামিয়ার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে না। তাঁদের সেই কথা বলার অর্থ, শক্তি, সময় কোনটাই নেই। আমি এদের শ্রদ্ধা করি। তুই কি করিস ? বল ! বল আমাকে। তুই তো শুধু বাপের অন্ন ধ্বংস করিস। তোর দাদা ছিল চেয়ারম্যান শাসক। মানে এ্যলিট শ্রেণীর লোক তোরা। তোরা এদের কষ্ট বুঝবি কি করে ? এরা কাউকে ঠকানো বোঝে না। এরা প্রতিনিয়ত ঠকে। তোর দাদার চেয়ে ভাল এরা। বুঝেছিস ?
– সরি, দোস। ভুল হইছে। মাপ কইরা দে। চল মোহাম্মদ আলী চাচার কাছে চল। মোহাম্মদ আলী চাচার বাসায় গিয়ে দেখা গেল। ৪ জন লোক মোহাম্মদ আলী চাচার চৌকির উপর বসে মহা সমারহে তাস খেলছে। চৌকির উপরে অনেক টাকা ছড়ানো। একজন আধাবুড়ো লোক কি একটা বিষয় নিয়ে বেশ হাসছিল। সে ওদের দেখে হাসি পুরোটা না থামিয়ে-ই জিজ্ঞেস করল
– কারে চান ভাই ? রঞ্জু এগিয়ে গিয়ে বলল
– মোহাম্মদ আলী চাচা আছেন ? অন্য একজন পাল্টা প্রশ্ন করল
– কোন মোহাম্মদ আলী ? বদ্দা ?
– হ্যা বদ্দা।
– হ্যায় তো বাড়িতে গ্যাছে গা। আর আইতো না।
– কেন ? আসবে না কেন ?
– হ্যার প্যনশন হইয়া গ্যাছে। রঞ্জু যেন শক খেল
– ও আচ্ছা। তার কোন মোবাইল নম্বর আছে ?
– হ্যার মোবাইল একটা আছিল। নম্বর তো জানি না।
-ঠিক আছে। যাই। একজন বলল
– বহেন। চা খাইয়া যান। মোহাম্মদ আলী আপনার কি লাগে ?
– কিছুনা, এমনি পরিচিত। আচ্ছা যাই।
– ঠিক আছে আবার আইসেন।
– আচ্ছা। রঞ্জু বেশ হতাশ হয়ে ফেরার পথ ধরল। সাকিব জিজ্ঞেস করল
– কিরে রঞ্জু মুড অফ নাকি ?
– নাহ্। মুড অফ বলতে মোহাম্মদ আলি চাচার জন্য মন খারাপ লাগছে। আমাকে খুব ভালবাসতেন, ¯েœহ করতেন। তাকে হারিয়ে ফেললাম। আউয়াল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল
– হ্যায় তো তোর জন্য ভাইগা গ্যাছে গা। চল বাসায় যাই। ৩ জন আবার ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল।
– ওদের ৩ জনের মনেই একটা আশা, নাজমুল এবার ওদের জন্য বেশ ভাল সংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে। হয়তো দেখা যাবে ২ জনের চাকুরির-ই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সাকিব আর আউয়ালের তো অনার্স শেষ। রঞ্জুর ও শেষ হতো। একবার ইয়ার ফাইনাল দিতে পারে নাই অসুস্থতার জন্য। অথবা এও হতে পারে যে ওরা মাশরুম চাষের জন্য কিছু টাকা চেয়েছিল তাও দিতে পারে। কিংবা এমনও কি হতে পারেনা যে সাকিব আর আউয়ালের চাকুরির ব্যবস্থা করেছে আবার রঞ্জুকে ব্যাবসা করার জন্য হাজার বিশেক টাকা দিল। তবে এবার ওদের জন্য কিছু একটা যে করবে সে ব্যাপারে ওরা শিওর। নাজমুল ভাই কথা দিয়েছে। হয়তো এত দিন ইচ্ছা ছিল কিন্তু কোন সমস্যার কারণে পারেনি। ওরা বেশ আশা নিয়ে-ই পথ চলছে। তবে রঞ্জুর একটু ভয় ভয় ও করছে। নাজমুল রঞ্জুর কাছে ৫০০ টাকা পায়। আবার নাজমুলের ফোন
– রঞ্জু বেশ ঝামেলায় পরছি।
– কি হইছে ? কি ঝামেলা ভাই ?
– অরে বাস পৌঁছাতে আরও ঘন্টা খানেক লেট হবে।
– কোন সমস্যা নাই আমরা কলা বাগান আপনারে আনতে যামুনে। কোন ভয় নাই। রঞ্জু ফোন রেখে বলল
– মামা তাড়াতাড়ি চল। দশটা তো বাজে। ওভার ব্রীজের এ্যাকশন শুরু করি।
ওরা ওভার ব্রীজের কাছে এসে পৌঁছাল। আউয়াল বলল
– তোরা দুইজন দুই মাথায় পাহাড়ায় থাকবি। দেখবি কোন মানুষ বা পুলিশ আসে নাকি ? কেউ আসলেই জোরে কাশি দিবি। ঠিক আছে ? দুই জন দায়িত্ব বুঝে নিয়ে যথা স্থানে চলে গেল। আউয়াল বড় দান বাক্সটার পাশে গিয়ে দাড়ালো। চারদিক মোটামুটি নিরব। শুধু ব্রীজে নীচ দিয়ে গাড়ী যাচ্ছে। আসে পাশে ওরা দু’জন ছাড়া লোকজন নাই। দান বাক্সটা বেশ বড়। ভালই মালপানি আছে ভাবল আউয়াল। মাগার তালাটাও বেশ বড়। বেশ মোটা সিকল দিয়ে থামের সাথে আটকানো। তবুও মামা আশা ছাড়লনা। ও তালাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ রঞ্জুর কাশি শুনে ও দানবাক্সের কাছ থেকে প্রায় ছিটকে এলো। দু’জন লোক বেশ গল্প করতে করতে উঠে আসছে। পিছনে আছে ৩/৪ জন। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আউয়ালের। এত রাত্রে হারামজাদারা চায় কি ? সবাই চলে যাওয়ার পর আউয়াল রঞ্জুকে বলল
– একটা ইট লাগবে। তালা ভাঙতে হবে।
– তুই দাড়া আমি দিতাছি। কিছু সময় পরে রঞ্জু এক থান ইট সহ আউয়ালের কাছে এলে। আউয়াল সাবধান করে দিল
– শোন এবার বেশ ভালভাবে খেয়াল রাখবি। এক-ই কথা সাকিব কেও বলে দিল।
– ইট দিয়ে তালা ভাঙব। ঝড়,বেশ সাবধান থাকবি।
আউয়াল ইট হাতে বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল। এদিক ওদিক ভালা ভাবে তাকিয়ে দে এক ঘা। আবার নাহ্। তালার কিছু-ই হলনা।
আবার পর পর ৩/৪ ঘা। একটু বিরতি দিল। হঠাৎ সিড়ির দিকে চোখ যেতেই আবার আগের মত ছিটকে এল। এবার পুলিশ পিছনে রঞ্জু। আউয়াল রেলিং এ ভর দিয়ে গুন গুল করতে লাগল। পুলিশ এসে বলল
– এই এখানে কি করিস। আউয়াল এক গাল হেসে বলল কই কিছু-ই না। এমনি দাড়িয়ে আছি। আউয়াল লক্ষ করল সাকিব আর রঞ্জু এসে দাড়িয়েছে।
– কি করিস ?
– স্টুডেন্ট। তিতুমিরে মাস্টার্স করছি।
– কাউ দেখি ? শংখনীল কারাগার ছবির আবুল হায়াতের মত আউয়াল অবশেষে আইডি কার্ড দেখালো।
– দান বাক্সের কাছে গেছিল ক্যান ?
– কোথায় ?
– তুই দান বাক্সের কাছে যাস নাই ?
– নাহ্ । আমি দান বাক্সের কাছে যাবো কেন ?
– কোথায় থাক ? আউয়াল যেখানে থাকে ঠিক তার উল্টো দিকে দেখিয়ে বলল
– মনিপুরি পাড়া।
– যান ভাই বাসায় যান। দিন কাল ভাল না। একটা বিপদে পরবেন। আউয়াল সুবোধ বালকের মত চলে আসছিল। তখন পুলিশ সাকিব আর রঞ্জুর —- দিকে তাকিয়ে বলল
– এই তোরা কি চাস ? ভাগ। শালার পাবলিক। ওরা দুজন ও নেমে এলো। ১৫/২০ মিনিট পরে সবাই বাসার সামনে একত্রিত হল। আউয়াল রঞ্জুকে জিজ্ঞেস করল
– তুই কাশ দিরি না কেন ? আমারে তো প্রায় লাল ঘরে ঢুকাই ছিলি।
– আমি কাশ দিয়েছি ইভেন তোর নাম ধরে ডেকেছি। তুই তালা ভাঙায় ব্যস্ত ছিলি শুনিস নাই।
সাকিব বলল
– এখন কি করবি বল ? নাজমুল ভাই তো চলে এলো বলে।
– দাড়া দেখি। আউয়াল নড়ে চড়ে বসল। তোরা আমার সাথে আয়। জীবনের লাস্ট চিকিৎসা করি। কিন্তু যা করার চোখের পলকে করতে হবে। খুব দ্রুত। তবে শিওর টাকা পাব।
– টাকা পাওয়ার পর রঞ্জু সাথে সাথে কলা বাগান চলে যাবি নাজমুল ভাইকে আনতে। আর সাকিব আর আমি যাবো কাওরান বাজারে বাজার করতে। ঠিক আছে ? রঞ্জু অধৈর্য্য হয়ে বলল
– সব-ই ঠিক আছে, কিন্তু কি করবি ?
– চল যা দেখতে পাবি তা শুনে লাভ কি ? ওরা ৩ জন পাশের গলিতে চলে এলো। আউয়াল রঞ্জুকে বলল
– তোকে যখন বলব টান দে- সাথে সাথে তুই একটা বস্তা ধরে টান দিয়ে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাবি।
ওরা ৩ জন একজন ভিক্ষুকের পাশে গিয়ে দাড়াল বয়স ৬০/৬৫ বা কম বেশীও হতে পারে। বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সময়ও মাথায় টুপি। আউয়াল এদিক সেদিক তাকিয়ে সাকিব কে কানে কানে কিছু বলে দিল। রঞ্জু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা বৃদ্ধকে শুন্যে তুলে ধরল। আর রঞ্জুকে বলল
– টান দে রঞ্জু। রঞ্জু সব বুঝতে পারল। ও নির্দেশ মত কাজ করল। রঞ্জু বাসায় এসে বস্তায় হাত দিয়ে দেখে অনেক টাকা। ২০ টাকা, ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫ পয়সার কয়েন পর্যন্ত। তার মানে বৃদ্ধের সর্বস্ব। একটু পরে সাকিব আর আউয়াল হাপাতে হাপাতে বাসায় এসে ঢুকল। বস্তায় সব মিলিয়ে তেরশ উনত্রিশ টাকা ২৫ পয়সা পাওয়া গেল। আউয়াল রঞ্জুকে ১০০ টাকা দিয়ে বলল
– যা তুই কলা বাগান গিয়ে নাজমুল ভাইকে নিয়া আয়। আমরা বাজার করে নিয়ে আসি। রঞ্জু বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
– দেখিস সাকিবের প্রিয় খাবার মুরগীর পা, পাখা, চামড়া মাথা নিয়া আসিস না। সাকিব বলল
– ভাগ হারামি।
– সাকিব আউয়াল কাওরান বাজারে চলে এলো। বাজার এখন বন্ধ প্রায়। অনেক দোকানদার-ই গুটিয়ে চলে গেছে। কেউ বা যাই যাই করছে। তবুও ওরা বাজার করতে পারল। কাওরান বাজার বলে কথা। ২ কেজি দেশী মুরগী কিনল। নাজমুলে দেশী মুরগী প্রিয় কিনা। সে হাঁসের ডিমও পছন্দ করে ৮ টা হাঁসের ডিম, ৩ কেজি পোলাউ এর চাল, ঘি, পেঁয়াজ, তেল, আদা কোন কিছু-ই বাদ গেল না। আউয়ালের চাপা চাপিতে শেষ পর্যন্ত এক প্যাকেট বেনসন ও কিনল। মেহমান আগে থেকে-ই সিগারেট খায়। আগে যা পেত তাই খেত। এখন নিশ্চয় বেনসন ছাড়া অন্য কিছু খায় না। সাথে ২টা মিষ্টি পান নিতেও ভুল করলনা। খাওয়া দাওয়া বেশ ভাল-ই হবে। শেষে যদি পান খেতে চায়। রান্নায় সাকিবের হাত বেশ ভাল। রঞ্জু তো বলেই দিয়েচে সাকিব মেয়ে হলে রঞ্জু ওকে শুধু রান্নার জন্য বিয়ে করত। সাকিব মহা উৎসাহে রান্না শুরু করল। রঞ্জুর দেখা নাই। রঞ্জু কলা বাগান গিয়ে মোবাইলে ২০ টাকা রিচার্জ করে নাজমুল কে ফোন করেছিল। সে জানিয়েছে আরও ২০ মিনিটের মত লাগবে। আধা ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে এখনও সিল্ক লাইন বাসের খবর নাই। কাউন্টারে ইয়া ভুরী ওয়ালা একজন বসে বসে সিগারেট ফুকছে। তার কাছে যতবার-ই জিজ্ঞেস করা হয় সে ততবার-ই সিগারেট টা লুকাবার ভঙি করে বলে
– এই তো দাদা ৫ মিনিট। ভুরি ওয়ালার ৫ মিনিট আর শেষ হয় না। শেষ পর্যন্ত ও আবার নাজমুলকে কল করল। নাজমুল ধরছেনা। কেটে দিচ্ছে। দ্বিতীয় বার কল দেয়ার আগেই বাস এসে ঢুকল। ৬ জন যাত্রী নামার পরে-ই নাজমুল নামল। অনেক মোটা হয়েছে। ফর্সাও হয়েছে বেশ। আবার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ীও রেখেছে। চোখে চশমা। ব্লেজার পরে এসেছে। হাতে ছোট একটা ব্রীফ কেস। দেখতে বেশ লাগছে। হিন্দি সিনেমার কোন, এক নায়কের মত লাগছে। কোন নায়ক রঞ্জু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না। রঞ্জু ৩২ দাঁত বের করে এগিয়ে গেল। রঞ্জুর ইচ্ছা ছিল জড়িয়ে ধরে নাজমুল ভাইকে। ওপাশ থেকে তেমন উৎসাহ দেখাল না দেখে শুধু হ্যান্ড শেক করেই ও ক্ষ্যান্ত হলো।
– চলেন । এই রিক্সা যাবেন ?
– রিকশা ক্যান একটা ক্যাব ডাক।
– এত কাছে ক্যাব যাবে না। রিক্সাই পাবেন।
– ঠিক আছে চল।
যেই নাজমুল পুরাতন বিমান বন্দর থেকে কাকরাইল হেঁটে গিয়ে টিউশনি করাতো যে আজ এই সামান্য রাস্তায়-ই ক্যাব খুঁজছে।
রিক্সায় তেমন কোন কথা হল না। বাসায় এসে সাকিব আর আউয়ালের সাথে সামান্য কুশল বিনিময়ের পরে-ই নাজমুল গোসলে ঢুকল।
এবার রান্নায় ৩ জন-ই লেগে গেল। বাথরুমের ভাল ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে। সাকিব একটা ইম্পোরিয়াল লেদার, সাবান ৩টা, মিনিপ্যাক শ্যাম্পু, একটা নতুন টুথ ব্রাশ রেখেছে কিছু সময় আগে। একদম ঠওচ ব্যবস্থা। নাজমুল ভাই বলে কথা। গোসল শেষে উনি মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি শুরু করল। মাঝে মধ্যে এক একজন এসে গল্প জমাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন জানি জমছে না। আগে কত্ত গল্প করত নাজমুল ভাই। এক সময় রান্না শেষ হল। আয়োজন খারাপ না। পোলাও, মুরগী ভূনা, ডিমের কোরমা, ঘন ডাল, দুধ কলা, কোল্ড ড্রিংকস। খাবার মেনু দেখে নাজমুল বলল
– এত্ত সব করতে গ্যালা ক্যান ? আউয়াল গলিত হাসি দিয়ে বলল।
– কিজে কন, আপনি আইছেন সে তুলনায় তো কিছু-ই করতে পারি নাই। ওর সাথে অন্য দুইজনও তাল মেলাল। খাবার শেষে নাজমুল পান সিগারেট দুটই বেশ আরাম করে খেল। সাকিবের ইশারায় আউয়াল আর রঞ্জু কিচেনে গেল। সাকিব অত্যান্ত ক্ষোভের সাথে বলল
– দেখছ কত্ত পরিবর্তন হইছে ? রঞ্জু বলল
– হুম দেখলাম তো ভাব খানা এমন যেন মন্ত্রী টন্ত্রী হইয়া গেছে। কি গম্ভীর। মনে হয় এর কিছু মনে-ই নাই।
– একবার জিগাইলো না যে আমরা কে কে করতেছি, কিভাবে চলতেছে আমাদের দিন কাল। কত্ত বড় মাল হইছে। যে একটা সময় আমাগো ছাড়া কিছু বুঝতো না। আউয়ালের কন্ঠে যেন রাগ ঝড়ে পরছে। বাদ দে চল আবার কিছু মনে করবে। সবাই এসে দেখল নাজমুল আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে মাত্র একটা খাট। এতে-ই ওরা ৩ জন ঘুমায়, এক একদিন এক একজনকে ফ্লোরিং করতে হয়। আজ মনে হয় ৩ জনকেই ফ্লোরিং করতে হবে। কারণ নাজমুল এমনভাবে খাটটা দখল করে ঘুমাচ্ছে ঐ খাটে অন্য কারও জায়গা হবে না। আউয়াল বেশ সাবধানে মশারি ছাড়া ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। তবুও শান্তি আছে। নাজমুল ভাই তো আরামে আছে। এতেই ওদের আরাম। বেচারা সারা জীবন বেশ কষ্ট করেছে। এখন আল্লাহ পাক তাকে আরাম দিছে, সম্মান দিছে, অর্থ দিছে আরাম করুক। নিশ্চিন্তে ঘুমাক।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ৩ জন-ইউঠে পরল। সাকিব রেস্টুরেন্ট থেকে পরোটা আর ডাল-ভাজি নিয়ে আসল, সাথে ৫টা হাঁসের ডিম। নাজমুলের যাতে ঘুম না ভাঙে সে দিকে খেয়াল রেখে নাস্তা রেডি করে তারপর ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে আউয়াল ওকে ডাকল। গোসলের জন্য কুসুম গরম পানি রঞ্জু রেখে দিয়েছে। গোসল শেষে সবাই মিলে নাস্তা সাড়ল। খাওয়া শেষে নাজমুল সিগারেট জ¦ালাতে জ¦ালাতে বলল- আমার বাস তো দশটায়। এ কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। মামুন বলল
– আপনি কইছিলেন ৫ দিন থাকবেন।
– সময় নাই ভাই সময় নাই। মাত্র ৫ দিন ছুটি প্রায় ২ দিন শেষ। বাড়িতে একটু যাবনা ? আউয়াল বলল
– আর একটা দিন অন্তত থাকেন।
– পরে আসব আবার। কথা দিলাম। হঠাৎ সাকিব বলল
– আমাদের জন্য কি ভাবলে ? বা কি করলেন ?
– তোমাদের আবার কি ? ৩ জন একত্রে থতমত খেয়ে গেল।
– এই তো, আমাদের চাকরি বাকরি তো কিছু নাই। অনার্স তো শেষ।
– ভাইরে চাকরির বাজার বড়-ই মন্দা।
– আমরা তো ভাই প্রায় না খাইয়া আছি। নাজমুল ৩২ দাঁত বের করে বলল
– কই দেখলাম তো ভাল-ই আছো। কেউ কোন কথা বলল না।
– দেখ, চেষ্টা কর। বিভিন্ন কোর্স টোর্স কর, চেষ্টা কর, তোমাগোর মেধা আছে, পাইয়া যাবা। একটু কষ্ট কর। এই যে আমি কম কষ্ট করছি। তোমরাই তো দেখছ। এখন মাসে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন পাই। এইডা কি কম কষ্টের ফল। ৩ জন একত্রে আশ্চর্য্য হয়ে বলে উঠল
– ত্রিশ হা-জা-র !!! নাজমুল আবার ৩২ দাঁত কেলিয়ে বলল
– এই সামান্য, তোমাদের দেখায় জানুয়ারী থেকে ৪০,০০০ পাব। ৯ তারিখ আবার দেশের বাহিরে যাব ৩ সপ্তাহের জন্য ট্যুর আছে। মামুন বলল
– তাইলে নাজমুল ভাই বেশ ভাল-ই আছেন
– এই তোমাদের দোয়ায় আছি মোটামুটি।
– সাড়ে আটটার দিকে সবাই মিলে গাবতলির দিকে রওনা দিল। খাওয়ার সময় আউয়াল বলল
– দেখেন নাজমুল ভাই আমাদের জন্য কিছু একটা করতে পারনে কিনা। বড় কষ্টে আছি ভাই। চাকরি বাকরি কিছু একটা না হইলে আর চলতেছে না। ব্যবসা পাতি করলে হইতো বড়-ই কষ্টে আছি ভাই।
– বুঝছি। দেখ, পলিট্রিক্স কর, নেতা-বড় ভাই ধর। আইজ কাইল আবার নেতা-খাতা, বড় ভাই টাই ভাড়া কাজ হয় না। সাকিব হঠাৎ বলল
– ভাই পলিট্রিক্স তো করছিলাম, বড় ভাইও ধরছিলাম। কাজ হইল না। কিরে মামা কাজ হইছে ? রঞ্জু কিছু না বুঝে-ই বলে ফেলল
– নাহ্ পলিটিক্সে কাজ হয় নাই।
বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত ওরা ভাবছিল যে একটা সময় নাজমুল ভাই তাদের অন্তত হাজার দশেক টাকা দিয়ে বলবে
– এটা দিয়ে আপাতত মাশরুমের চাষটা শুরু কর। পরে লাগলে তখন দেখা যাবে। নাজমুল ভাই মানুষকে চমকে দিয়ে বেশ মজা পায়।
বলা যায় না, আজও হয়তো শেষের দিকে ওদের চমকে দেবে।
এক সময় বাস স্টার্ট দিল। প্রথমে আউয়াল এরপর সাকিব সব শেষে রঞ্জু নাজমুলের সাথে হ্যান্ডশেক করল। শেষে যখন রঞ্জু হ্যান্ডশেক করছিল তখন নাজমুলের কানে কানে কিছু কথা বলল। বাস ছেড়ে দিল। প্রথমে ধীর গতিতে চলছে। সাকিবকে যখন নাজমুলে জানালা অতিক্রম করছিল তখন শেষ বারের মত সাকিব বলল
– ভাই আমাগো জন্য একটু ভাইবেন, বড় কষ্টে আছি। তখন নাজমুল একটা রহস্যময় হাসি দিল। যতক্ষণ বাস দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ দাড়িয়ে রইল। এক সময় আউয়াল বলল
– আউট অব সাইড আউট অব মাইন্ড।
চল।
– রঞ্জু ক্ষেপে গিয়ে বলল
– হেঁটে যাব নাকি ?
– হেটে না গেলে গড়িয়ে যাও। ৭ টাকা আছে। বাসের কন্ডাকটরকে দুলাভাই ডাকলে ৭ টাকা ফার্মগেট নিতে পারে।
৩ জন হাঁটতে শুরু করল। প্রায় সারাদিন ধরে হাঁটল। ৩টার দিকে মিরপুর বেরী বাঁধ গের। সারা দিনে কিছুই খায়নি। রঞ্জু ঘাসের উপর শুয়ে পরল, আউয়াল রঞ্জুর উরুকে বালিস বানিয়ে শুয়ে পরল আর সাকিব তার দুই হাত কে খুটি বানিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পরল।
আউয়াল রঞ্জুকে জিজ্ঞেস করল
– আচ্ছা তোর কানে কানে নাজমুর ভাই কি কইছিল রে ?
– বড় কষ্টের একটা হাস্যকর কথা।
– ভাব না মাইরা কইলে ক।
– হ্যায় কয় “ এই জামা কাপড় না পইরা আমার লগে না আইলেও পারতা একটু ভাল জামা কাপড় করতে পারতা না ? পরলে কি হইতো ?
সাকিব বলল
– তুই তখন হেরডা খুইলা ফেলতি। কইতি যে ভাই আমরা তো ৩০০০০ টাকা বেতন পাইনা আপনারডা নিলাম, কিছু মনে নিয়েন না।
– তিন জনে-ই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসি কমিয়ে রঞ্জু বলল
– কিরে বাসায় যাবি না খিদায় তো প্যাট জ¦লতাছে।
সাকিব বলল
– একটু পেট্রোল দে ভাল কইরা জ¦লব। আউয়ালের গানের গলা ভাল, সে গাওয়ার চেষ্টা করল-
“আগুনের কথা বন্ধুকে বরি দু’হাতে আগুন তারো কার মালা হতে খসে পরা ফুল রক্তের চেয়েও গাঢ়” ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল। সন্ধ্যা পার
হয়ে রাত্র নেমে এসেছে। রাতের সোডিয়াম লাইট জ¦লছে শহর জুড়ে। ওদের পাশ দিয়ে হুস হাস করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ী। ওরা ফার্মগেটের বড়
ওভার ব্রীজের উপরে উঠল। এবার গাড়ী যাচ্ছে ওদের নীচ দিয়ে। রঞ্জু বেশ কয়েকটা গাড়ীতে থুথু দিল। সাকিব বেসুর গলায় গাওয়ার চেষ্টা করল
“কানাই তুমি খেইর খেলাও ক্যানে——-
রঞ্জু লক্ষ করল সাকিবের দুই গাল বেয়ে পানি পরছে। আউয়াল মামা বিষন্ন দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রঞ্জুর চোখও জ্বালা করতে শুরু করল।

Leave a Reply

x

Check Also

লাইটার জাহাজের ধাক্কায় চরখালী ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে বিধ্বস্ত 🔴 যানবাহন চলাচল বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার কঁচা নদীর চরখালী-টগরা ফেরিঘাটের চরখালী ঘাটে একটি জাহাজের ধাক্কায় ফেরির ...