ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - বিলুপ্ত ঐতিহ্যের নকশার সেই শহীদ মিনারটি

বিলুপ্ত ঐতিহ্যের নকশার সেই শহীদ মিনারটি

 

দেবদাস মজুমদার>

মহান ভাষা সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক আর দ্রোহের মিলনস্থল শহীদ মিনারটি ছিল ৪৩ বছরের ঐতিহ্যে লালিত। জনপদের মানুষ সংকটে বিক্ষোভে- বিপ্লবে এই শহীদ মিনারের পদতলে এসে সমবেত হতেন। সেই অনন্য প্রতীক শহীদ মিনারটি নগরায়নের নামে গত পাঁচ বছর আগে ভেঙে ফেলে অন্য আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। ফলে আপন জনপদের অতি আপন চেতনার চির চেনা শহীদ মিনারটি হারিয়ে গিয়েছিল।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার অনন্য ভাষা সংগ্রামের প্রতীক ৪৩ বছরের পুরানো চির চেনা যে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছে.একুশ উদযাপন করেছে সেই হারানো শহীদ মিনারটির আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। হারানো নকশায় নির্মিত হয়েছে বিলুপ্ত ঐতিহ্যের সেই শহীদ মিনারটি। তিনযুগেরও বেশী সময়কার চীরচেনা শহীদ মিনারটি বিলুপ্ত করে নতুন নকশার শহীদ মিনারটি মঠবাড়িয়ার পৌরভবনের পাশে স্থাপন করা করা হলে পূর্বেকার নকশার শহীদ মিনারটি হারিয়ে যায়। তবে পুরানো সেই ঐতিহ্যের শহীদ মিনারটি এলাকার মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। ওই আদলে নতুন করে মঠবাড়িয়া মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা ডিগ্রী করেজ কর্তৃপক্ষ ৪৩ বছরের সেই পুরানো ঐতিহ্যের শহীদ মিনারটি কলেজ ক্যাম্পাসে নতুন করে নির্মাণ করে ঐতিহ্য সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। আর ঐতিহ্যের এ শহীদ মিনারটি নির্মাণে মঠবাড়িয়া পৌর সভার মেয়র মো. রফিউদ্দিন আহম্মেদের প্রচেষ্টায় পৌর কর্তৃপক্ষ ১০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়।

মূল বেদীর ওপর প্রায় ২৯ ফুট উচ্চতার এ শহীদ মিনার আগামী একুশে ফেব্রুয়ারী সকালে মঠবাড়িয়ার ভাষা সৈনিক মো. হাবিবুর রহমান খান এ শহীদ মিনার চত্বরের দ্বার উন্মোচন করবেন। পুরানো শহীদ মিনারটি ফিরছে আপন আদলে এমন খবরে এলাকার মানুষের মনে কিছুটা আনন্দ ফিরছে।
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা ডিগ্রী কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখো গেছে, কলেজ ক্যাম্পাসের সম্মূখ মাঠের দক্ষিণ পাশ জুড়ে বিশাল বেদীর ওপর প্রায় ২৯ ফুট উচ্চতার পুরানো শহীদ মিনারটির নির্শাণ করা হয়েছে। শহীদ মিনারটি আগামী ২১ ফ্রেবুয়ারী সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বার উন্নোাচন করতে কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শহীদ মিনারের চারপাশ জুড়ে পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ লাগােনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ ও পিরোজপুর জেলা পরিষদ সদস্য মো. আজীম উল হক জানান, ১৯৬৮ সালে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শুরুতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী কে.এম লতিফ ইনস্টিটিউশনে একুশ উদযাপনের প্রথম উদ্যোগ নেয় কয়েকজন শিক্ষার্থী। তখনও এ জনপদে কোন শহীদ মিনার গড়ে ওঠেনি। এই উপকূলে এমন নকশার শহীদ মিনার আর দ্বিতীয়টি নেই। মা তাঁর দুই সন্তানকে আগলে আছেন দৃশ্যত এমনই বিমূর্ত চেতনায় গড়ে উঠেছিল এই শহীদ মিনারটি। এই শহীদ মিনারটি নিয়ে জনপদের সকল মানুষের মুগ্ধতা ও গর্ব রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ২০১৩ সালে ৪৩ বছরের পুরাতন শহীদ মিনারটি স্থানান্তর কের পৌর প্রশাসন। এতে শহীদ মিনারের মূল নকশাটি বিলুৃপ্ত হয়ে যায়। এতে নাগরিকদের মধ্যে পুরানো শহীদ মিনারটি ঘিরে নানা আলোচনা ওঠে। শহীদ মিনারটির আদল ফিরিয়ে আনতে মহিউদ্দিন আহম্মেদ মহিলা কলেজ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অনুধাবন করে ৪৩ বছরের পুরানো শহীদ মিনারের আদলে নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এজন্য পৌর প্রশাসন ১০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদ দেয়। তিন মাসে শহীদ মিনারটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়। আগামী একুশে ফ্রেব্রুয়ারী সকালে পুরানো শহীদ মিনারের নতুন করে দ্বার উন্মোচন করা হবে। ফলে ৪৩ বছরের হারানো ঐতিহ্য সুরক্ষা হবে।

ইতিহাস অনুসন্ধানে জানাগেছে,১৯৬৮ সালে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের শুরুতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী কে.এম লতিফ ইনস্টিটিউশনে একুশ উদযাপনের প্রথম উদ্যোগ নেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তখনও এ জনপদে কোন শহীদ মিনার গড়ে ওঠেনি। উদ্যোগী কয়েকজন ছাত্র মিলে শহীদ মিনার তৈরী করবেন ঠিক করলেন। এজন্য দু চারআনা পয়সাও উত্তোলন করে ছাত্ররা । এরপর বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনের সামনেই স্থান ঠিক করা হয়। গৃহস্থের বাড়ি থেকে কেটে আনা হয় কলাগাছ। দ-ায়মান কলাগাছে কালো কাপড় মুড়িয়ে তৈরী হয় মঠবাড়িয়ার প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৬৮ সালেই প্রথম শহীদ মিনারে একুশ উদযাপন করে এখানকার শিক্ষার্থীরা।
এর পর ১৯৬৯ সালে এসে কলাগাছ আর কালো কাপড়ে মোড়া শহীদ মিনারটি বদলে যায়। ওই শহীদ মিনার নির্মাণে রাজমি¯ত্রী ছিলেন মঠবাড়িয়ার সবুজ নগর গ্রামের মো. মতিয়ার রহমান।
১৯৭১ সালে কে.এম লতিফ ইনস্টিটিউশনের পাকা শহীদ মিনারটি মুক্তিকামী বাঙালীর মত সেদিন বিপন্ন হয়ে পড়ে। ওই সময় স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লেিগর তথাকথিত টাইগার ফোর্সের রোষানলে পড়ে মঠবাড়িয়ার মেধাবী ছাত্ররা। পাক আর্মিরা তাদের সহযোগিতায় মঠবাড়িয়ার মেধাবী ছাত্রদের আটক করে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে মাটিতে গুড়িয়ে দেয়। প্রথম শহীদ মিনার গুড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন গণ পরিষদ সদস্য ও উপকুলীয় অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শহীদ সওগাতুল আলম সগীর এর নেতৃত্বে মঠবাড়িয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার গড়ে তোলার উদ্যোগ শুর হয়। শহীদ মিনার নিমাণ বাস্তবায়ন কমিটিও গঠন করা হয়। সওগাতুল আলম সগীর ওই কমিটির সভাপতি ও তৎকালীন সিও আব্দুল হাই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মঠবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রের কমিউনিটি সেন্টার সামনে(বর্তমান পৌরভবন)শহীদ মিনারের দৃশ্যমান স্থান নির্ধারণ করা হয়। প্রথমে ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে সেখানে শুর করা হয় পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর। ২৯ ফুট উচ্চতার শহীদ মিনারটি সেদিন নকশা করেন প্রকৌশলী মো. শফিকুল আলম। যিনি এলাকায় সকলের মেজদাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথম ধাপে ২১ হাজার টাকায় নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ায় আরেক ধাপ বরাদ্দ বেড়ে যায়। সর্বমোট ৮৭ হাজার টাকা ব্যায়ে তৈরী হয়ে যায় ২৯ ফুট উচ্চতার আমাদের শহীদ মিনার। এ শহীদ মিনার নির্মাণ দায়িত্ব পালন করেন দুই ঠিকাদার ঠিকাদার আব্দুল আজিজ মৃধা ও প্রমথ রঞ্জন হালদার। শহীদ মিনারের নকশা চূড়ান্ত করতে তিনটি নকশা করেন প্রকৌশলী । পরে সকলের সম্মতি ক্রমে বর্তমান বিলুপ্ত নকশাটির অনুমোদন হয়।
সেই নকশার অন্তর্গত আদলে তিনটি দণ্ডায়মান স্তম্ভ। তিন ধাপের উচ্চতার এ স্তম্ভ সংযুক্ত ছিল আড়াআড়ি দুই পিলারে। মা যেমন সন্তান আগলে রাখেন তেমনি ধারনা থেকেই নির্মাণ করা হয়েছিল শহীদ মিনারটি।

মঠবাড়িয়ার সংস্কৃতিজন শিবু সাওজাল বলেন, ১৯৭৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আগেই আমাদের মূল শহীদ মিনারটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল। ওই বছর প্রথম শহীদ মিনারে মঠবাড়িয়াবাসী একুশের অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। এরপর টানা ৪৩ বছর সময়কাল ধরে এই শহীদ মিনারের স্থাপনাটি মঠবাড়িয়ার জনমানুষের চেতনাকে জাগিয়ে রাখে। এখানকার সংকট ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিপ্লবে এর পদতলে সমবেত হন মানুষ। এমন নকশার শহীদ মিনার দেশের আর কোথাও নেই, এমন স্বকীয়তায় এ জনপদের মানুষ গর্ব করেন এখনও। সেই ঐতিহ্যের শহীদ মিনারটি ফিরে আসুক এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ইকতিয়ার হোসেন পান্না বলেন,পৌরভবন দৃষ্টিনন্দন ও দৃশ্যমান করতেই আমাদের ঐতিহ্যবাহি শহীদ মিনারের স্থাপনাটি ভেঙে অন্য নকশায় করা হয়েছে। আর তা হয়েছিল নাগরিক সমাজের একটি সভায়। তিনযুগেরও বেশী সময়ের ঐতিহাসিক একটি স্থাপনার নকশা বাদ দিয়ে ভিন্ন নকশায় নিমাণ যথার্থ ছিলনা। তবে আশার মহিউদ্দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ পুরানো সেই নকশার শহীদ মিনারটি ফিরিয়ে আনল।

এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা এমাদুল হক খান বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের ঐতিহ্যের পুরানো শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। এটি অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ। এতে কিছুটা হলেও আমাদের ৪৩ বছরের ঐতিহ্যের নকশাটি সুরক্ষিত হবে। তবে আমাদের শহরের কেন্দ্রীয় একটি শহীদ মিনারটি পুরানো নকশার আদলে শহরের বালুর মাঠে প্রশস্ত স্থানে নির্মাণে দাবি তুলছি।

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...