ব্রেকিং নিউজ
Home - এক্সক্লুসিভ - লর্ড লিখব না স্যার, আপনি নম্বর কাটলে কাটেন….

লর্ড লিখব না স্যার, আপনি নম্বর কাটলে কাটেন….

সাইফুল বাতেন টিটো >

আমি হাইস্কুল জীবন শেষ করেছি দুটি স্কুলে। প্রথমে ক্লাস সিক্স থেকে এইটের দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত পড়েছি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ীয়া থানার ধানী সাফা হাইস্কুলে আর ক্লাস নাইন থেকে এসএসসি পর্ন্ত পড়েছি একই জেলার মঠবাড়িয়া থানার কে.এম. লতীফ ইনস্টিটিউশনে। আজকের যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসেছি সেই বিষটি আমার হাইস্কুল জীবনের প্রথমাংশের ঘটনা, অর্থাৎ সাফা হাই স্কুলের ঘটনা। যখন আমি ক্লাস এইটে উঠলাম তখন আমাদের পরিবেশ পরিচিতি সমাজ নামে যে বইটি ছিলো তাতেই ইতিহাস, ভুগোল, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থ বিজ্ঞান সব মিলিয়ে জগা খিচুড়ি টাইপের একটা বই বলেই মনে হতো আমার কাছে। তো সেই জগা খিচুড়ি গলধ করণ করানোর মহান দায়িত্বে ছিলেন পরিমল হালদার স্যার। উনি পড়া দিতেন আর নিতেন। ক্লাসের শুরুতে নতুন চ্যাপ্টার ধরে কোন এক ছাত্রকে পড়তে বলতেন, তার পড়া শেষ হলে বলতেন “আগামী কাল এই পর্যন্ত পড়া।” তার পর চ্যাপ্টারটটা নিয়ে বিশদ আলোচনা শুরু করতেন। স্যার বোঝাতেন চমৎকার করে। চ্যাপ্টার শেষ হলে উনি প্রশ্ন মুখস্ত করতে দিতেন। আর সে প্রশ্নের উত্তর হতে হবে ওনার তৈরি করে দেয়া নোটেরর হুবহু কপি। একটু এদিক সেদিক হলে উনি পরিমল থাকতেন না হয়ে যেতেন গনগনে সূর্য্য। এটা আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগত। সব স্যারের মারার অস্ত্র বেত থাকলেও উনি হাত দিয়ে মারতে বেশী পছন্দ করতেন। পরিমল স্যার সাইজে ছোট খাট থাকলেও তার শরীর ছিলো বেশ শক্ত পোক্ত। যাকে বলে মুগুর ভাজা শরীর। মানে যদি ধুতি পরা পরেশ রাওয়ালের কথা ভাবেন তাহলে ঐ অমনই। তো স্যার পড়া না পারলে ছাত্রটির মাথার পিছনে হাত দিয়ে কপাল ঠেকিয়ে দিতেন বেঞ্চের সেখানে যেখানে শাবকটির বই থাকতো সেখানে। তার পর তার সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে কিল দিতেন। না হাতের নরম পাশ পিঠে লাগতো না, লাগতো শক্ত আঙ্গুল গুলো। এমন মার একটা খেলেই শিশুদের শ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। আমি প্রায়ই খেতাম। কারণ পড়াশুনার ব্যাপারে আমি কোন কালেই বিন্দু মাত্র সিরিয়াস ছিলাম না। যখন যা ভালো লাগতো তাই পড়তাম। তবে ইতিহাস আমাকে ভীষন টানতো। আমার বাবা এমনিতে পেশায় ইংরেজী শিক্ষক। কিন্তু ইতিহাস তার প্রিয় বিষয়। দুজনের প্রিয় বিষয় ইতিহাস সেটা বাপ-বেটা দুজনেই যেদিন টের পেলাম সেদিন আব্বু আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত পলাশী যুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে ‘৭১ পর্যন্ত বললেন। আমি কতটুকু বুঝেছিলাম তা জানি না কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দবস্ত, নীল চাষ, বর্ণ বৈষম্য, লুটপাট, নানা শারিরিক মানসিক অত্যাচার ইত্যাদি শুনে ব্রিটিশদের প্রতি আমার চরম একটা রাগ তৈরি হলো। পুরো ঘটনার সময় অামি অনেক লর্ডদের নাম ও কৃত্তি শুনেছি। আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
– লর্ড মানে কি?
– প্রভু।
এর কিছুদিন পর আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা এলো। আমি আমার মতো পরীক্ষা দিলাম। আমাকে নিয়ে আমার পরিবারের তথা স্কুলের স্যারদের অনেক আশা আমি এইটে বৃত্তি পাব। সো আমার প্রতি তাই সবার একটু এক্সট্রা কেয়ার। তো যেদিন খাতা দিলো সেদিন আমি সমাজের নম্বর দেখে তো অবাক! খুবই কম নম্বর পেয়েছি লিখিত পরীক্ষায়! পঞ্চাশে মাত্র ২৯!!! স্যার খুব রেগে আছেন আমার উপর। আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে গিয়ে দেখালাম যে স্যার আমার একটি কারেক্ট শুন্যস্থান পূরন, দুটি সত্য মিথ্যা, দুটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে কোন নম্বরই দেন নি। আমি সেটা স্যারের গোচরিভুত করতেই স্যার আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরলেন। আমার উপর বেশ কিছুক্ষণ মুগুর ভাজার পর যখন আমাকে ছাড়লেন তখন আমার মাথার চুল আউলা ঝাউলা, চোখে প্রচন্ড ক্রোধ! আর সে ক্রোধ আমি পুরোটাই ঢেলে দিয়েছি ফ্লোরের উপর।
কিছু সময় পর স্যার আমাকে কাছে ডাকলেন। বলেন
– কেন নম্বর কাটছি বুঝতে পারছস?
– না স্যার।
এর পর স্যার আমার খাতাটা নিয়ে উত্তরের যায়গাটা বের করে বললেন
– দেখ তুই কোন লর্ডের নামের আগে লর্ড লেখস নাই। লর্ড ক্লাইভের নাম লেখছস শুধু ক্লাইভ, লর্ড ডালহৌসিকে লিখছস শুধু ডালহৌসি। কেন?
আমার সাহস বেড়ে গেলো। আমি স্যারকে বললাম
– স্যার লর্ড মানে কি?
– লর্ড মানে কি তুই জানস না? তুই না বৃত্তি দিবি? লর্ড মানে প্রভু, শাসক।
– স্যার ওরা তো চোর, ডাকাত ওরা আমাদের লর্ড হতে যাবে কেন?
– এটা কেমন কথা? এটা তো নিয়ম।
– কে বানিয়েছে এই নিয়ম?
– ব্রিটিশরা!! আর আমরা তা বলতে বাধ্য?
– কিন্তু স্যার কেন? এখন তো আর দেশে ব্রিটিশ নাই। এখন তো আমাদের দেশ আমরা চালাই। আমরা এখনও ঐ চোর, বাটপার, শোষক, ডাকাতদের কেন লর্ড বলতে যাব? আমি কোন দিনও লর্ড লিখব না স্যার। আপনি নম্বর কাটলে কাটেন। ক্লাস এইটে পড়া এক কিশোরের কাছ থেকে এমন কথা স্যার হয়তো আশা করেন নি। তাই এবার স্যার আরো খেপে গেলেন। আবার আমাকে মারলেন। আমি স্যারের প্রতি খুব রেগে গেলাম। ভাবলাম জীবনে আর স্যারের সাথে কথা বলব না।
তার পরের গল্পটা আবার ভিন্ন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এলাম ফিল্ম মেকার হব বলে। সাফা স্কুলে আর পড়া হয়নি। ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম অন্য স্কুলে। তার পর কলেজ পাশ করলাম, আর্মীতে চাকরী নিলাম। কেটে গেল অনেক দিন। খুব সম্ভবত ২০০৪ কিংবা পাঁচ সালের কথা। আমি ছুটিতে বাড়ীতে গিয়েছি। তো আমাকে আমার এক সাফা স্কুলের সহপাঠি বলল
– দোস্ত পরিমল স্যার খুব অসুস্থ। হয়তো বাঁচবেন না বেশীদিন। সম্ভব হলে স্যারকে একটু দেখে আসিস। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মূহুর্তে আমার সমস্ত রাগ উবে গেলো। আমার বাবা শিক্ষক। জানি সেদিন পরিমল স্যার আমাকে সন্তান জ্ঞান করেই মেরেছিলে। বাজারের মাঝামাঝি যায়গায় স্যারদের একটি পারিবারিক দোকান রয়েছে সেই সাথে স্যার ও স্যারের যৌথ পরিবার। আমি ছুটে গিয়ে স্যারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দুজনেই কাঁদছি। কেন কাঁদছি হয়তো দুজনেই জানি কিংবা একজনেও জানি না। এমসময় স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে টেনে তুললেন। দেখলাম স্যার অনেক শুকিয়ে গেছেন। অনেক সময় ধরে অনেক কথা বললাম। আমাকে ভিতর থেকে ঘরে বানানো সন্দেশ আর ঝকঝকে পিতলের গ্লাসে পানি খেতে দেয়া হলো। আমি যখন বিদায় নিয়ে ফিরছিলাম তখন স্যার আবার পিছন থেকে ডাকলেন।
– শোন, সেদিন তুই ঠিকই বলেছিলি। আমরা এখন স্বাধীন। কোন ব্রিটিশ চোর, ডাকাত, দালাল, নিপিড়ককে আমরা কেন এখন আর লর্ড বলব? তুই কোন দিনও কোত্থাও লর্ড লিখবি না। অন্য সবাই যাতে লর্ড লেখা বন্ধ করে পারলে বন্ধ করবি। আমি স্যারকে আবার জড়িয়ে ধরে আবার দুজন অঝোরে কাঁদলাম।

© কস্মিন কালের কথা,

লেখক : মিডিয়া কর্মী

Leave a Reply

x

Check Also

মঠবাড়িয়ায় জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি সংগঠনের উদ্যোগে রোজদারদের ইফতার বিতরণ

মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটির উদ্যোগে মাহে রমজানে সহস্রাধিক মানুষের ...