ব্রেকিং নিউজ
Home - খোলা কলাম - স্বপ্নের অন্তরালে নক্ষত্র

স্বপ্নের অন্তরালে নক্ষত্র

সব সময়ে স্বপ্নের অন্তরালে কিছু দুঃস্বপ্নের দেখা মেলে। মাঝে মাঝে নক্ষত্রকে নিয়ে চিন্তা হয়, ওকে যদি হারিয়ে ফেলি, চলতে পারবো তো বাকি জীবন একা একা।পড়াশুনা শেষ করেছি গত একটা বছর হলো কত গুলো ইন্টাভিউ দিলাম কোনও ভালো খবর এলোনা, তার মানে নক্ষত্রের না। তবুও জীবনের এই প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে এগিয়ে যাব, নিরন্তন আশায় বুক বাধি।প্রতিদিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেড়িয়ে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে, সাথে সহযোদ্ধা জীবন সঙ্গীনি নক্ষত্র থাকে। চাকুরির বাজারে যেমন গনিত ইংলিশ পারলে চাকুরি পাওয়ার সম্ভাবনা জাগে, তেমনি আমাদের স্বপ্ন সম্ভবনা সব সময় জেগে থাকে,অন্ততপক্ষে শিক্ষা ক্যাডার টাই যেন পাই। মাঝে মাঝে পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত বোধ করি তখন দুজনেই বেড়িয়ে পড়ি, কিছুক্ষনের জন্য চুটিয়ে প্রেম করে, আবার ফিরে আসি পড়ার টেবিলে।

শতকষ্টের মাঝেও আমাদের বুকে চলছে উচ্চ স্বপ্ন বিলাসের উচ্ছসিত দীর্ঘশ্বাস।মাঝে আমাদের মেলা মেশা দেখে অনেকের হিংসা হয়। অনেকে কুট কুট স্লেজিংওকরে। একবার ফুলার রোডে এক ত্যাড়া মাস্তান স্লেজিং করেছে মাথায় যেন রাগে ফেটে যাচ্ছে, পরক্ষনে ওকে উত্তম মাধ্যম মারতে শুরু করি।তবে নক্ষত্র আমাকে টেনে ছিচরে নিয়ে আসে, আর যেখাবে ওকে মারছো ও তো মরে যাবে!!

আমিও বলেছিলাম, তোমার জন্য আমি পৃথিবীর সব কিছুই করতে পারি।কথা গুলো মনে হয় প্রেমের বিশ্বস্ততার পথিক।প্রতি বন্ধের দিন আমরা দুজনেই জমিয়ে ছুটি কাটাই, প্রিয় ঢাকা ছাড়াও ঢাকার আশে পাশে সব জায়গাতে গিয়ে সারাদিন মাস্তি সন্ধায় আগেই বাসায় রওনা দি।এর ভেতরে একটা বিসিএস এর ভেতরে প্রিলিমিনারিতে পাশ করি, রিটেনের জন্য পড়াশুনার তোর জোর শুরু করি। স্বপ্ন বুঝি আজ খুব বেশি দূরে নয় নিকট সন্নিকটে। হঠাৎ একদিন গ্রামের এক কাকা ফোন করে বলল তোর বাবা অসুস্থ্য! খবরটা আমার কাছে অালো থেকে অন্ধকারে প্রবেশের মত মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কান্না আর চেপে রাখতে পারলাম না। নক্ষত্র বিভিন্নভাবে আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।নক্ষত্র আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাস টার্মিনালে এসে বিকালে গাড়িতে তুলে দিও।আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি সবই হাড়াচ্ছি!! সব দিক থেকে ঝড় উঠছে কোন মানুষের ক্ষতি না হলে ও আমার যে অফুন্ত ক্ষতি হতে যাচ্ছে।গভীর রাতে যখন বাড়িতে ফিরি তখন দূর থেকে কান্নার অাওয়াজ ভেসে আসছে বুঝতে আর বাকি নেই।জানি জন্মিলে মরিতে হবে, কিন্তু বিধি আমি কোনও অন্যায় করিনি!! যে পিতা আমাকে সেই ছোট থেকে অাদর যত্ন করে টাকা পয়সার খরচ করে গ্রামের সর্বচ্চো শিক্ষিত করেছে, যে স্বপ্ন দেখতো তার ছেলে একদিন পুলিশের এ এস পি হয়ে তা পা ছুয়ে শপত নিবে, দেশের সমস্ত অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবে, কিন্তু কেন এমন করলে বিধি!! নিজেকে নিয়তির যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে, কষ্টটা চেপে রেখে পিতাকে শেষ বিদায় জানিয়ে এলাম।আজ মমতাময়ী মা যে বড় একা হয়ে গেছে।

আজ সাত দিন হলো মা কোন কিছু খেতেই চায় না, সারাক্ষণ পতি হারানোর শোকে মুহ্যমান থাকে। আমার কিছু যেন ভালো লাগে না, নক্ষত্র পিতার মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন ফোন করেছিল, তার হাতে ও সময় কম আমাকে ও বলেছে যত তারাতারি পারো ঢাকায় চলে এসে পরিক্ষায় তারিখ পড়েছে।আমি এখন কি যে করি বুঝতে পারছি না, বিধি কিছু একটা পথ দেখাও!! প্রতিবেশি কাকাকে ডেকে এনে মাকে বোঝাতে থাকি, সামনে তো বিসিএস রিটেন পরিক্ষা বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে মা।তার জন্য আমাকে ঢাকা যেতে হবে, তুমি ও আমার সাথে চলো? মা তার স্বামীর ভিটা ছেড়ে যাবে না। বরং আমাকে বলল তুই ঢাকায় পরিক্ষা দিয়ে চলে আসবি?

আমি ঢাকায় চলে আসি কেননা পরীক্ষার আর এক সপ্তাহ বাকি। ঢাকায় এসে নক্ষত্রকে ফোন করি কিন্তু রিসিভ করেনা।পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আছে হয়ত।আবার পড়ার জন্য কাকডাকা ভোরে লাইব্রেরিতে যাই, কিন্তু আজ যে নক্ষত্র আসেনি!! ফোন করলাম কোন রেসপন্স করলো না।দশটার সময় ফোন করে বলল, সমুদ্র আমি বাসায় আছি আমার এক কাজিন গনিতে খুব ভালো তার কাছে এই এক সপ্তাহ গনিত প্রাকটিস করবো!! আর তোমার সাথে এ কয়দিন আর দেখা হবে না!!! কেন জানি মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হতে শুরু হলো।গত পাঁচটি বছর যাকে ছেড়ে দুইদিন ও থাকে পারিনি, সে ও পারেনি। আজ এক মাস হয়ে যাচ্ছে সে আমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে না!! হাজার ও ভাবনাতে দুপুর গড়িয়েছে বন্ধু সৌম্য বলে নক্ষত্র পাশে নেই, তাই বলে দুপুরের লাঞ্চ করা ভুলে গেলি নাকি? দুই টা বাজে পরে গেলে খাবার পাবি না। বন্ধুদের সাথে খুব বেশি মিশতে পারিনি, নক্ষত্রের সাথেই পুরো ছাত্র জীবন, তাই পরিচিত ফেসের বন্ধুরা অনেকে অনেক সময় ঠিস মেরে কথা বলে।
পরিক্ষা শেষ হলো, মা বাড়িতে চলে আসতে বলে, আজ নক্ষত্রকে বেশি মনে পড়ছে, ওকে একটা ফোন করি! ও রিসিভ করে বলে, সমুদ্র আজ কাজিনের সাথে স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখছি, সন্ধায় তোমার সাথে দেখা হবে। আজ দেড় মাস পড়ে তোমাকে দেখার জন্য মনটা উচাটন, আর তুমি কাজিনের সাথে সিনেমা হলে ! ব্যস্ সব তোমার ঠিক মত চলছে তাহলে আমি কেন তোমার পথের কাটা হবো।দুপুরের গাড়িতে বাড়ির দিকে রওনা হলাম, মোবাইল সিমের দোকান থেকে নতূন একটা সিম নিলাম পুরোনো সিমটা ফেলে দিলাম, সাথে হাজার হাজার ঘন্টার স্মৃতি চিরতরে মুছে দিলাম।
বাড়িতে এসে দেখি মায়ের অবস্তা বেশি ভালো না। মাকে ডাক্তার দেখাই, কিছুতেই মা সুস্থ্য হচ্ছে না।ডাক্তারের পরামর্শে হসপিটালাইজ করি প্রায় তিন মাস মায়ে সাথে হাসপাতালে। রাতে মায়ের পাশেই ঘুমিয়েছি, শেষ রাতে দিকে মা ডাকছে সমুদ্র ওঠ বাবা, তোর বাবা আমাকে ডাকছে, তুই আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবার কাছেই যাচ্ছি।যে টুকু স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলাম, সেটাও কাঁচের মত ভেঙে গেল। বিধি তুমি এত নিষ্ঠুর কেন??
বাবাকে নিয়ে গেলে, সে কষ্ট ভুলতে না ভুলতে মাকে ও নিয়ে গেলে। তোমার কি কোন দয়া মায়া নেই।আমাকে এভাবে এতিম করে দিলে।প্রতিবেশি রা হাসপাতালে এসে আমাকে সবাই স্বান্তনা দিচ্ছে, অনেক ভাবে বুঝাতে চেষ্টা করছে। মা হারানোর বেদনা সহজে মন থেকে মোছা যায় যে হারায় শুধু সেই জানে।

তিন বছর পর আমি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের চাকুরি করি, নিজের খরচ রেখে বাকিটা গরীব মানুষের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করি।আমার স্কুল আর বাচ্চাদের সুখেই দিন যাচ্ছে, পাখির কিচিরমিচির মত বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি চলে যাচ্ছে দিন। আমার স্কুল টা তিন বছরে অনেক সুনাম অর্জন করেছে।গত বছর জেলায় প্রথম হয়েছে, এবার বিভাগের প্রথম হয়েছে।আমাদের স্কুলের জন্য সরকার এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোসনা করেছে। আগামীকাল জেলার ডিসি অফিসে পুরস্কার আনতে আমাকে যেতে হবে। সকাল সকাল আমি আর আমার দত্তক সন্তান, আসলে ও আমার মত এতিম একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় ওর বাবা মা নিকট আত্মীয় সবাই কে হারিয়েছে, সেই ছোট থেকে মানুষ করছি, তাই ও এখন আমাকে বাবা বলে ডাকে।ডিসি অফিসের সম্মেলন কক্ষে সারা জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রা উপস্থিত। সবাই আমার পরিশ্রমের প্রসংশা করছে। পুরস্কার বিতরন শুরু হলো, দশম তম স্থান থেকে শুরু করেছে, জেলা প্রসাশক ও জেলা শিক্ষা কর্মকতা দু-জনেই এক সাথে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন। সব শেষের ডাক পড়লো বকুলপুরর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাননীয় প্রধান শিক্ষক মিঃ সমুদ্র। পিছনের সারিতে বসে ছিলাম, দাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জেলা শিক্ষা কর্মকতা ও দাড়িয়ো গেলেন। চেয়ে দেখি শিক্ষা কর্মকতা হলেন, মিস নক্ষত্র। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, আমি আর বল্টু(পালিত সন্তান) মঞ্চে এগিয়ে গেলাম। নক্ষত্র অপলোক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁধে সরকারি বড় দায়িত্ব, দায়িত্বের খাতিরে কর্তব্য করছে জানি, তবে নক্ষত্রের ভেতরে কি আমার মত অনুভূতি হচ্ছে? আমি কোন মতে সামনে এগিয়ে গিয়ে মঞ্চের সকলের সাথে সালাম সাথে হ্যান্ডশেক করছি, এক এক করে সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ।এবার নক্ষত্রের হাতে হ্যান্ডশেক বুকের ভেতরটাতে বিদ্যুতের মত চমকাতে লাগলো। ক্ষন কাল দোরি না করে জেলা প্রসাশকের সাথে হাত মিলাই। নক্ষত্র আর জেলা প্রসাশকের হাত থেকে এক লক্ষ টাকার চেক ও পুরস্কার হাতে নিতে সাংবাদিকদেরা ছবি নিতে শুরু করলো।বল্টু আবার চেঁচিয়ে বলল বাবা আমিও ছবি করবো!! বল্টু কে কোলে নিয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকালাম, ও যেন বিমর্ষ হয়ে গেল, দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।
কিছুক্ষনের ভেতর আমাকে ডেকে পাঠালো জেলা শিক্ষা অফিসারে রুমে। রুমে যেতেই দেখি চা নাস্তা আমার জন্য সব রেডি সাথে কাম্পাস জীবনে আমার সেই প্রিয় আচার টাও। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র বলে ফেলল, কেমন আছ?তোমার সন্তান তো তোমার মত হয়নি, তবে কি ওর মায়ের মত হয়েছে?
ভালো আছি তবে তোমার নয়।হুম ওর বাবা মায়ের মত হয়েছে?
ওর বাবা মা মানে?
ঠিকই বলছি। আমি ওকে একটা কার এক্সিডেন্ট থেকে উদ্ধার করি। দুর্ঘটনায় কেউ জীবিত ছিল না শুধু বল্টু ছাড়া। তাই ওর বাবা আমি।আচ্ছা তোমার ছেলে কয়জন?
আমার কোন ছেলে মেয়ে নেই?
তবে তোমার স্বামী কি করে?
স্বামীকে কোন দিন খুঁজে পাইনি। তাই সংসার করাও হয়নি।

(উৎস্বর্গ স্নেহের অনুজ সমীর বিশ্বাস বাপ্পি, এমএসসি গনিত বিভাগ, ঢাকা কলেজ)

লেখক > দয়াল কুমার গাইন,সহকারী মিডিয়া প্রোডাকশন,পারিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর,কাওয়ান বাজার ঢাকা

Leave a Reply

x

Check Also

আমাদের একটা ডিসেম্বর ছিলো

  সারাবছরে অন্তত একটা মাস বাচ্চাকাচ্চাদের ছুটি দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে ডিসেম্বর মাসটাই মোক্ষম। আমরাও ডিসেম্বর ...